প্যাট্রিয়ট পার্টি: নয়া দল গঠনের স্বপ্ন ট্রাম্পের!

অনিন্দ্য সাইমুম ইমন

হোয়াইট হাউজে চার বছরের বসবাসের পাট চুকিয়ে প্রেসিডেন্টের বিশেষ উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে চেপে ওয়াশিংটন ছেড়ে ফ্লোরিডার পথ ধরেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পালাবদল ঘটেছে বৈশ্বিক ক্ষমতা চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হোয়াইট হাউজে। এখন এ সাদা বাড়ির নতুন বাসিন্দা ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ট্রাম্পের ভবিষ্যত্ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। সহজভাবে বললে, এখন কী করবেন ট্রাম্প? অবসর কাটাবেন নাকি নতুন কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? মার্কিন গণমাধ্যমের খবর, এখনই রাজনৈতিক উচ্চাশা ছাড়ছেন না ট্রাম্প। প্যাট্রিয়ট পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। নতুন এ দল মার্কিন রাজনীতিতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক শিবিরের বাইরে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভূমিকা রাখবে।  

ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিদায়ের আগে ট্রাম্পকে ঘিরে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। কেননা নির্বাচনে পরাজয়ের পরও তিনি হার স্বীকার করে নেননি। অভিনন্দন জানাননি বাইডেনকে। এমনকি বিদায়ী ভাষণে একবারের জন্যও বাইডেনের নাম মুখে নেননি। একই পথে হেঁটেছেন সদ্যবিদায়ী ফার্স্টলেডি মেলানিয়াও। ট্রাম্প দম্পতির এমন আচরণ মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে নয়া নজির হয়ে থাকবে। 

তবে জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে হোয়াইট হাউজ ছেড়েছেন এ দম্পতি। আপাতত তাদের নিবাস ফ্লোরিডার বিলাসবহুল মার-এ-লাগো গলফ রিসোর্ট। এর মালিক ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। বিশ্বস্ত কয়েকজন সহযোগীসহ আপাতত ট্রাম্প দম্পতি এ রিসোর্টে থাকবেন।

ট্রাম্প বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবল চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিত। কখন কী করবেন, কী বলবেন তা আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন। স্বাভাবিকভাবে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার পর ট্রাম্পের পরবর্তী কর্মকাণ্ড নিয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা দুষ্কর। যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছে। তাই চলছে নানা জল্পনাকল্পনা। বিশেষত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিদায়ী ভাষণে ট্রাম্পের আত্মপ্রত্যয় ও ‘কাজ শেষ না হওয়ার’ বয়ান নতুন করে ভাবাচ্ছে সবাইকে।

সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ক্ষমতা ছাড়ার পর অবসর জীবন কাটান। সেবামূলক কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। ভাষণ দেন, বই লিখেন, তহবিল সংগ্রহ করেন। রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা একেবারে সীমিত হয়ে আসে। এটাই মার্কিন রাজনীতির রীতি ও ঐতিহ্য।

২০১৭ সালে যখন বারাক ওবামা ক্ষমতা ছাড়েন তখন তার বয়স ৫৬ বছর। শারীরিকভাবে এখনো যথেষ্ট কর্মক্ষম তিনি। পরিবার নিয়ে বাস করছেন ওয়াশিংটনের একটি ভাড়া বাড়িতে। ওবামা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে ওবামার নতুন বই। এসব করেই কেটে যায় সময়। যদিও ট্রাম্পের আমলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের পর ঐতিহ্য ভেঙে রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়েছিলেন ওবামা। বাইডেনের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও।

ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৪ বছর। এ বয়সে তিনি নিজের রিসোর্টে অখণ্ড অবসর কাটাবেন—এটাই সবার প্রত্যাশা। তবে মানুষটা যখন ট্রাম্প, তখন প্রত্যাশার পারদ সব সময় একই বিন্দুতে মিলবে এমনটা আশা করা বোকামি। শুধু গলফ খেলে ট্রাম্প বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন, এটা আশা না করাই ভালো। 

‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’—এ ট্যাগলাইন বাস্তবায়নের এজেন্ডা নিয়ে চার বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিলেন ট্রাম্প। বিদায়ী ভাষণে তিনি দীপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘যা করতে এসেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করেছি। আমেরিকাকে বিশ্ববাসী ফের সম্মান করতে শুরু করেছে।’ বিদায়ী ভাষণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ট্রাম্প। তা হলো ‘আমেরিকাকে মহান (গ্রেট) করার কাজ এখনো শেষ হয়নি। এটা চলবে।’

হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে আনপ্রেডিক্টেবল ট্রাম্পের এমন আত্মবিশ্বাসী বয়ান ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়লেও এখনই রাজনৈতিক উচ্চাশা পরিহার করছেন না ট্রাম্প। এরই মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ক্ষমতা ছাড়ার আগের দিনগুলোয় কাছের মানুষদের কাছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। দলটির নামও ভেবে রেখেছেন—প্যাট্রিয়ট পার্টি বা দেশপ্রেমিকদের দল।

ট্রাম্প পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী ও মিডিয়া সেলিব্রিটি। রাজনীতির তুলনায় ব্যবসাটা ভালো বোঝেন। বাইডেনের মতো কয়েক দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তার নেই। কাজেই নতুন রাজনৈতিক দল করলে তাকে সমমনা রিপাবলিকান রাজনীতিক ও আইনপ্রণেতাদের নিজের পক্ষে টানতে হবে। এ সম্ভাবনা থেকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের নতুন করে রাজনীতিতে আসার ইঙ্গিত দুটো ঘটনার জন্ম দিতে পারে। প্রথমত, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার রীতি-ঐতিহ্য ট্রাম্পের হাত ধরে নতুন রূপ পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন রাজনীতে নয়া টানাপোড়েন তৈরি করতে পারেন ট্রাম্প। বিশেষত রিপাবলিকান পার্টিতে বাজতে পারে ভাঙনের সুর।

তবে রাজনীতির মাঠে ট্রাম্পের নবযাত্রা মোটেও সুখের হবে না। এক মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুবার অভিশংসনের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। প্রথমবার ২০১৯ সালে, ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে। ওই সময় রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেট অভিশংসন প্রস্তাব খারিজ করে দিলে হোয়াইট হাউজে টিকে যান ট্রাম্প। 

চলতি বছর মার্কিন পার্লামেন্ট ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় উসকানি দেয়ার অভিযোগে কংগ্রেসে অভিশংসিত হয়েছেন ট্রাম্প। সিনেটে এর শুনানি এখনো বাকি। যেহেতু এরই মধ্যে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাই মার্কিন পার্লামেন্টের উদ্যোগে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পের নতুন করে রাজনীতি শুরুর স্বপ্ন ধূলিসাত্ হয়ে যাবে। তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে পারবেন না, বলছিলেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু অ্যাকারম্যান। 

এবারের নির্বাচনে হারলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে ট্রাম্প-বাইডেনের। এতে প্রমাণ হয়, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা মোটেও তলানিতে নয়। এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে চাইছেন ট্রাম্প। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছেন হয়তো। সমস্যা হলো ট্রাম্পের সমর্থকরা বেশ উগ্র ও একগুঁয়ে শ্বেতাঙ্গবাদী। আগামীতে তাদের সমর্থন ও কর্মকাণ্ড রিপাবলিকানদের এখন থেকেই ভাবিয়ে তুলেছে। ট্রাম্প ও তার উগ্র সমর্থকরা দলটির জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে। তাই তো সিনেটের জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে হামলার জন্য ট্রাম্পের উসকানি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রবীণ এ নেতা ট্রাম্পের নয়া রাজনীতির পথ রুদ্ধ করতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে। 

ট্রাম্পের সামনে এখন দুটো বিকল্প। সাবেক প্রেসিডেন্টদের মতো অবসরকালীন জীবনে সেবামূলক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। এ বিষয়ে বিল ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারক ওবামার দৃষ্টান্ত এখনো তার সামনে রয়েছে। কিংবা নতুন করে রাজনীতির স্বপ্ন এগিয়ে নেয়া। বিশেষত ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেকে প্রস্তুত করা। প্রথম বিকল্পটি খুবই সাধারণ ও প্রথাগত। দ্বিতীয়টি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষত বয়স, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। এখন দেখার বিষয়, আনপ্রেডিক্টেবল ও একগুঁয়ে ট্রাম্প কোন পথে হাঁটেন। 

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন