করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ প্রায় ১১ মাস। এ সময়ে টেলিভিশন, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম চললেও তাতে অংশ নিয়েছে মাত্র সাড়ে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই এখন স্কুল খোলার পক্ষে। গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে পরিচালিত ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২১’-এর অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে এ মত উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটিতে ধাপে ধাপে বিদ্যালয় খোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য প্রথমে যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ কম, সেসব এলাকায় স্কুল খোলার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। অন্যদিকে বড় শহরগুলোয় মার্চে স্কুল খোলার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত ক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। একই মত দিয়েছেন ৮০ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন এ প্রতিবেদনের এবারের সমীক্ষার বিষয় ‘কখন ও কীভাবে স্কুল খুলে দেয়া যায়’। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গতকাল এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সমীক্ষায় আট বিভাগে আট জেলা থেকে ২১ উপজেলা নির্বাচন করা হয়। এছাড়া ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুর বস্তি এলাকা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষায় মোট ২ হাজার ৯৯২ জন উত্তরদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৭০৯ জন শিক্ষার্থী (ছেলে ও মেয়ে সমসংখ্যক), ৫৭৮ জন শিক্ষক ও ৫৭৬ জন অভিভাবক রয়েছেন। অন্যরা জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিয়ে এ সমীক্ষা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ক্লাস চললেও তাতে অংশ নেয়নি ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে ক্লাস করতে পারেনি। গ্রাম এলাকায় এ হার ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অনলাইন ক্লাস আকর্ষণীয় না হওয়ায় অংশ নেয়নি ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। করোনার পুরো সময় বাড়িতে নিজে নিজে পড়াশোনা করার কথা জানিয়েছে ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পোষানোর ব্যাপারে সমীক্ষায় বলা হয়, ৬২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন ক্ষতি পোষাতে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন।
৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতামত, যেসব বিষয় পড়ানো হয়নি, তা আগে পড়ানো হোক। ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী ক্লাসে প্রোমোশন চেয়েছেন। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যেসব পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি, তা দিতে চেয়েছেন ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, উপস্থিতির হার কমে যেতে পারে। ৪১ দশমিক ২ শতাংশ মাধ্যমিকের শিক্ষক মনে করছেন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমতে পারে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে। ৪৭ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ৬৪ শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে। ৫৩ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষক ও ৪৮ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষক বিদ্যালয় খোলার আগে পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রাথমিকের ৮৪ ও মাধ্যমিকের ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক টয়লেটসহ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি করা দরকার বলে মনে করেন।
প্রতিবেদনের সুপারিশে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত স্কুল খুলে দেয়া, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষার ক্ষতি পুনরুদ্ধার, শিক্ষক সহায়তা এবং শিক্ষার পুনরুদ্ধার বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনায় মনিটরিং জোরদার করার কথা বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সক্ষমতা বিবেচনা করে বিদ্যালয় খুলতে হবে। আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলিনি, তবে ধাপে ধাপে খুলতে বলেছি। কবে বিদ্যালয় খোলা হবে, সে ব্যাপারে আগেই ঘোষণা আসা উচিত। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে পারবে।
ব্র্যাকের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও এডুকেশন ওয়াচের প্রধান গবেষক মনজুর আহমদ বলেন, প্রথমে গ্রাম এলাকায় এবং পরে মার্চে বড় শহরের স্কুলগুলো খুলতে হবে। এজন্য ব্যবস্থাপনার সামর্থ্য ও অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন, মোহাম্মদ মহসীন, অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ ও ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।