স্নেহভাজন মুস্তাফিজ শফি মূলত একজন সাংবাদিক। যতদূর জানি, তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন ছাত্রাবস্থায়। ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আজ শফি সংবাদমাধ্যমের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। পালন করছেন গুরুদায়িত্ব।
বর্তমানে তিনি দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথিতযশা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর পর শফির ওপর সমকালের দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমি সমকালের একজন পাঠক, আবার লেখকও। সমকালের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা ও বিশেষ সংখ্যায় লিখি। ধারণা করি, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আমাকে লেখার তাগিদ দেয়ার পেছনে শফির পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ফোনে মাঝে মাঝে তার সঙ্গেও কথা হয়।
মুস্তাফিজ শফির ধীরে ধীরে আজকের পর্যায়ে উঠে আসার পেছনে নিশ্চয়ই তার যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতা, দূরদর্শিতাই মুখ্য। পেশায় সাংবাদিক হলেও শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার দাপুটে বিচরণ রয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখছেন। তিনি একজন গীতিকারও। তবে কবি হিসেবে তার পরিচিতি একটু বেশি ব্যাপৃত। শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী সৃজনশীল মুস্তাফিজ শফির নিসর্গ ও চিত্রকলার প্রতিও ব্যাপক আকর্ষণ রয়েছে বলে জেনেছি। তার লেখায় এরও প্রতিফলন ঘটেছে। একজন সৃজনশীল-সৃষ্টিশীল মানুষ তার কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকেন, পরিধি বিস্তৃত করেন। শফি এমনই একজন ৫০ পূর্ণ করা তরুণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, ৫০ বছর বয়স যার, তাকে তরুণ বলছি কেন? আমি মনে করি, তারুণ্য শুধু বয়সের গণ্ডিবদ্ধ নয়। যার চিন্তা-চেতনা তারুণ্যছোঁয়া, তার বয়স যতই হোক তিনি তরুণই। সেই অর্থে শফি আমাদের তারুণ্যেরই একজন উজ্জ্বল প্রতিনিধি।
শিশুতোষ একাধিক রচনাও রয়েছে তার। তাহলে এও বলা যায়, তার সাহিত্যচর্চার পরিধি এরই মধ্যে অনেক বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। মেধা-মনন-সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তার এই চাকচিক্য তাকে পঞ্চাশেই আলোকিত করেছে—একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার সামনে আরো বিস্তর সময়। কার জীবনের সীমা কতটা নির্দিষ্ট তা আমরা কেউ জানি না। তবু মানুষ তো সম্মুখপানেই তাকায়। এ অনুযায়ীই নিজেকে গড়ার, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছকও কষে মানুষ। শফির সঙ্গে দেখা হয়েছে কম। কিন্তু তাকে ভালোভাবেই জানি, চিনি। অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ হিসেবে তার পরিচয়ের সীমানাও বিস্তৃত সংবাদমাধ্যম ও সৃজনশীল-সৃষ্টিশীলতার পরিমণ্ডলে। শফি সে রকমভাবেই নিজেকে নির্মাণ করেছেন এবং এখনো তার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত। এমন মানুষের জীবন তো আলোকিত হতে বাধ্য।
শফি পঞ্চাশেই যেটুকু স্থান করে নিয়েছেন, আশা করি ভবিষ্যতে তা আরো পুষ্ট হবে নিশ্চয়। একজন সৃজনশীল-সৃষ্টিশীল ও কর্মমুখর মানুষ প্রতিক্ষণ যেমন নিজেকে বিনির্মাণের চেষ্টা করেন, তেমনি অন্যের জন্যও কিছু রেখে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালান তার শৈল্পিক অনুভূতির তাগিদেই। কবি, গল্পকার, গীতিকার ইত্যাদি নানা পরিচয়ে পরিচিত শফির সৃষ্টি নিয়ে, কর্ম নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। আরো হয়তো অনেকে লিখবেন। আমি খুব সংক্ষেপে তাকে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চেনাজানার ভিত্তিতেই বিশ্লেষণ করলাম। কেউ যখন উঁচু পদে আসীন হন, তখন তাদের অনেককেই পদের ভারভারিক্কি করে তোলে। শফি এ কাতারের মানুষ নন। একজন মানুষের এও নিশ্চয় বড় একটা গুণ এবং এই গুণই তাকে দৃষ্টান্ত ও অনুসরণযোগ্য করে তোলে।
আপসহীন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা একজন নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকের দর্শন। সাহসের সঙ্গে অকপটে সত্য উচ্চারণে একজন সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা রয়েছে তার বিবেকের কাছে। বৈরী পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও সত্য উপস্থাপনই আদর্শ সাংবাদিকতার প্রতিপাদ্য। তাছাড়া সম্পাদকের মতো সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ পদে যারা আসীন, তাদের আরো বেশি সতর্ক-সজাগ ও দায়বদ্ধ থাকতে হয়। দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মুস্তাফিজ শফি সুচারুভাবে এর স্বাক্ষর রাখতে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন—এটুকু পত্রিকাটির পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক-সম্পাদকের শক্তিশালী ভূমিকায় আমাদের সংবাদমাধ্যম আজ অনেক বিকশিত। ভবিষ্যতে এর আরো বিকাশ ঘটাতে নিশ্চয়ই আরো অনেকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন। শফি তাদের কাতারেও অগ্রগণ্য থাকবেন—এই আস্থা রাখি।
ক্রিকেটে শতক-অর্ধশতক একজন ক্রিকেটারের জীবন খতিয়ানে বিশেষভাবে যুক্ত হয়। ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসের সেই আলোকে বলতে পারি, শফি অর্ধশতক পূরণ করলেন। আমি কামনা করি, শতকও পূর্ণ হোক তার। নন্দিত কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক শফির গ্রন্থ সংখ্যাও কম নয়। এ থেকে পরিষ্কার সাক্ষ্য মেলে, শফি শিল্প-সাহিত্যের একজন নিরন্তর সাধক। এত গুরুদায়িত্ব পালনের পরও তার এই সংখ্যা বা তালিকা ক্রমদীর্ঘ হচ্ছে, এটাও তো কম কথা নয়—যা অনেকের পক্ষেই দুরূহ। ‘মায়াবতী আজ আমি শূন্যতার ভেতর/আগামীর যোগফল খুঁজি’—এই দুটি লাইন তারই কবিতা থেকে নেয়া। কবে কোথায় পড়েছি মনে নেই, তবে লাইনগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। না, শফি; শূন্যতায় নয় পূর্ণতায়ই আগামীর যোগফল খুঁজুন। শুভকামনা মুস্তাফিজ শফির জন্য। জীবনজয়ী হোন—এ কামনাও রইল। তার মূল যে পরিচয় সাংবাদিক—এর আরো বিকাশ ঘটুক। সমান্তরালে অন্য পরিচয়ও তাকে আরো আলোকিত করুক। সাংবাদিকতা পেশার পথ এখন প্রত্যাশিতভাবে মসৃণ নয়। এই পথটা মসৃণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার জোরদার প্রচেষ্টা দরকার। মুস্তাফিজ শফি এ কাতারেও থাকুন। অভিবাদন, শফি।
হাসান আজিজুল হক: কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ