টিকাদান

সম্মুখসারির যোদ্ধারা সবার আগে পাক

এক-দুই দিনের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত কভিড-১৯ টিকা আসার প্রেক্ষাপটে দেশে টিকাদানের জোর প্রস্তুতি চলছে। একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের পাশাপাশি জাতীয়ভাবে টিকাদান ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন মোটামুটিভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। গাইডলাইন অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় ৩০০ কেন্দ্রসহ সারা দেশে হাজার ৩৪৪টি কেন্দ্রে করোনার টিকা দেয়া হবে। একটি কেন্দ্রে দুজন টিকাদানকারীর সঙ্গে চারজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ জন মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা আছে। এর যথাযথ সুষ্ঠু বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ।

পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। টিকাদানে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা মহড়া (ড্রাই রান) খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও ধরনের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্সসহ এরই মধ্যে টিকাদান শুরু করা সব দেশই মহড়া চালিয়েছে। ভারতেও গত শনিবার দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রম শুরুর আগে এক সপ্তাহের মহড়া কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে। মহড়ার মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে এর সমাধানও পাওয়া যায়। সন্দেহ নেই, অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় আমদানির ক্ষেত্রে সময় ব্যয় বেশি লাগায় বাংলাদেশে মহড়া খুব একটা সহজ নয়। তবুও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞরা খুব সীমিত পরিসরে মহড়া পরিচালনার পরামর্শ দিচ্ছেন। ইতিবাচক বিষয়, ধরনের মহড়া পরিচালনার খবর শোনা যাচ্ছে। কাজটি যথাযথভাবে করা প্রয়োজন। একইভাবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হলে কাদের এরই মধ্যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে এবং কাদের হয়নি, তা জানা যাবে। গত আগস্টে আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাবাসীর শতাংশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৭৮ শতাংশরই কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। অবস্থায় অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হলে টিকা দেয়ার বাছাই প্রক্রিয়া আরো সহজতর হবে বৈকি। টিকাদানের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ঘাটতিও বিরাজমান। করোনা টিকা বিশেষ পরিস্থিতির হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষণের কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটি আরো জোরদার করা চাই। সুষ্ঠুভাবে টিকাগ্রহীতাদের নিবন্ধন করাটাও একটি চ্যালেঞ্জ। অনেক দেশ ভিড় বিশৃঙ্খলা এড়াতে অনলাইনে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছে। ভারত মোবাইল অ্যাপস চালুর মাধ্যমে নিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশেও এটি সম্ভব। সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল। এছাড়া প্রত্যেকের একক জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও আছে। ২৬ জানুয়ারি থেকে ধরনের একটি মোবাইল অ্যাপস চালুসহ ডিজিটাল নিবন্ধন শুরু করবে বলা হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো গেলে নিবন্ধন সহজ হওয়ার পাশাপাশি ভোগান্তিও অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি ম্যানুয়েল ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। চলমান মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রে করোনার টিকা সম্মুখসারির যোদ্ধাদের জন্য খুশির সংবাদ। অগ্রাধিকার তালিকার ভিত্তিতে সবার আগে তাদের টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।   

পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত থেকে আসা টিকা নিজস্ব সংরক্ষণাগারে রাখবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। সেখান  থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা পর্যায়ের টিকা কেন্দ্রে বা উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাবে। করোনা টিকা নিয়ে মানুষের বিপুল আগ্রহ থাকায় রাখার জায়গা, পরিবহন টিকা কেন্দ্র তিনটি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আছে। বিশেষত টিকা কেন্দ্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশি। কাজেই সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সব পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত কোল্ড চেইন বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত প্রস্তুতি বাড়ানো দরকার। এদিকে ঢাকায় সমস্যা এক ধরনের এবং ঢাকার বাইরে আরেক ধরনের হওয়ায় জাতীয় টিকাদান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় এই এলাকাগত ভিন্নতার বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি। খবর মিলছে এখন পর্যন্ত বেশকিছু জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়নি। এতে জেলা-উপজেলায় অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা নিশ্চিত করা জটিল হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য বা অন্য প্রভাবশালীদের মধ্যকার কমান্ড নিয়ে ঝামেলা বাধার আশঙ্কাও আছে। একেকজন একেকভাবে পরিচালনা করার চেষ্টা করবেন। লকডাউনের সময়ে ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা গেছে। জেলা সিভিল সার্জন না জেলা প্রশাসকটিকাদান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেলা পর্যায়ে কে হবেন চূড়ান্ত নেতৃত্ব ব্যক্তি, তা ওপর থেকে আগেই নির্ধারণ করা জরুরি। এছাড়া জনসাধারণ টিকার গুরুত্ব বা ঝুঁকির বিষয়টি ঠিকমতো কতটা বুঝতে পারবে তা- বড় এক প্রশ্ন। এজন্য প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন। চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এসব সম্ভাব্য কারিগরি বিষয়ও সংশ্লিষ্টদের ভাবনায় রাখতে হবে।

রোগী চিহ্নিত করা থেকে চিকিৎসাপ্রতিটি ক্ষেত্রে চলমান মহামারীতে কিছু অব্যবস্থাপনা ছিল। টিকাদান ব্যবস্থাপনায় আগের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত পরিকল্পনা মাঠ পর্যায়ে সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিশ্চয়ই আসবে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে সেগুলো দেশীয় বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নিরসন করতে হবে। শক্তির দিক হলো, ইউনিয়ন পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বিস্তারের সুবাদে আমাদের একটি বড় জনবল আছে। রয়েছে গতানুগতিক টিকাদান কর্মী। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এনজিওগুলোরও একটা বিশাল কর্মী বাহিনী বিদ্যমান। তাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে গণটিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন