মানব পাচার মামলায় ১১ মাসে সাজা হয়েছে একটি

নিহাল হাসনাইন

মানব পাচার মামলায় ৯০ দিনে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার বিধান আইনে রয়েছে। কিন্তু ধীরগতির তদন্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে এসব মামলা। আবার বিচারে গিয়েও অধিকাংশ মামলায় হেরে যাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে মানব পাচারের মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র একটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আইনি লড়াই পরিচালনা করতে গিয়ে অধিকাংশ মামলাতেই অপরাধীরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।

মানব পাচারের মামলা পর্যবেক্ষণের জন্য গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ সেলের তথ্য বলছে, গত বছরের প্রথম ১১ মাসে সারা দেশে মানব পাচারসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৪৯৯টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সেপ্টেম্বরে মাসে ৬৫টি। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে হাজার ২৭ জন। মামলাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে আসামিদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রমাণ পেয়ে ৩০০টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। আর তথ্য-প্রমাণ না থাকায় ৪৩টি মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, যারা মানব পাচারের শিকার হন, তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। জীবন নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের কৌশল হিসেবেই মামলার আশ্রয় নেন। এরপর তদন্ত চলা অবস্থাতেই আসামিপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে মামলা পরিচালনা ছেড়ে দেন। সাক্ষীর দিনও হাজির হন না। আর যারা মানব পাচারের পর জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারেন না, তাদের পরিবারের বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়ের করা মামলাগুলোই কেবল সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং আসামির সাজাও নিশ্চিত করা যায়।

যদিও মানব পাচার প্রতিরোধ দমন আইন অনুযায়ী, মানব পাচার আইনের অধীনে একটি আমলযোগ্য অপরাধ। এটি একদিকে যেমন জামিন অযোগ্য অপরাধ, তেমনি আইনের দায়ের করা মামলা আপসযোগ্য নয়। আইনের আওতায় দায়ের হওয়া মামলা ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। আর বিচারকাজ শেষ হতে হবে ১৮০ দিনের মধ্যে। মানব পাচার আইনের মামলাগুলোর বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য রয়েছে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন হতে হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, পুলিশের তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের সংশ্লিষ্টতা মিললেও বিচারে গিয়ে অধিকাংশ মামলাতেই পরাজিত হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। পুলিশের অভিযোগপত্র সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতে গত বছরের প্রথম ১১ মাসে শেষ হয়েছে ১৪টি মামলা। এর মধ্যে ১৩টিতে হেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। একটি মামলায় শুধু সাজা হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে ৪৮৫টি মামলা। আর আইনের অধীনে এখন পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে হাজার ৮৪৯টি মামলা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলোয় শক্তপোক্ত তথ্য-প্রমাণ ব্যতীত আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্তকারী সংস্থার দুর্বল অভিযোগপত্রে পার পেয়ে যায় মানব পাচারকারীরা। আবার কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ফলেও মামলার স্বাভাবিক তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি প্রসিকিউশন সার্ভিস পেতেও ভুক্তভোগীদের বেগ পেতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। এতে করে একদিকে যেমন মানব পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, অন্যদিকে ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ভুক্তভোগীরা।

মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলো মনিটরিং করে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখা। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে হালনাগাদ তথ্যসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের ১৪৫টি মামলা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৪৭৮টি মামলা। এসব মামলার অধিকাংশই সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিলম্বিত হয়ে চলেছে।

তদন্তে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, তদন্তই একটি মামলায় একমাত্র দিক নয়। যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করেন, তখন তাকে অবশ্যই পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। তিনি নিখুঁত তদন্তের চেষ্টা করেন, যদিও এক্ষেত্রে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমরা তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে থাকি, যাতে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিখুঁতভাবে তদন্ত শেষ করতে পারেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন