দিলীপ কুমারের বদলে অনিচ্ছুক গুরু দত্ত যেভাবে পিয়াসার নায়ক হলেন

২০১১ সালে টাইম ম্যাগাজিন ঘোষণা করেছিল, সর্বকালের সেরা ১০ রোমান্টিক সিনেমার একটি পিয়াসা। আর ২০০৫ সালে তাদের সর্বকালের সেরা ১০০ ছবির তালিকায়ও আছে গুরু দত্তের এই মাস্টারপিস। ছবির প্রযোজনা পরিচালনা করেছিলেন গুরু দত্ত। একই সঙ্গে ছবির মুখ্য চরিত্র ট্র্যাজিক কবি বিজয়ের চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। বলা হয়, ছবিতে পাঞ্জাবের কবি, গীতিকার সাহির লুধিয়ানভির জীবন লেখিকা অমৃতা প্রীতমের সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রেমের ঘটনার ছায়ার আঁধার দেখা যায়। কিন্তু ছবিতে বিজয়ের চরিত্রে গুরু দত্ত চেয়েছিলেন দিলীপ কুমারকে। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরু দত্তকেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। পর্দার পেছনের সেই গল্প হাজির করেছেন ভারতীয় লেখক সাংবাদিক ইয়াসের উসমান তার লেখাটি ভাষান্তর করেছেন শানজিদ অর্ণব

নিজের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত চলচ্চিত্র পিয়াসার জন্য গুরু দত্ত চাইছিলেন সে সময়ের সেরা অভিনেতাকে। তিনি চেয়েছিলেন ট্র্যাজেডি কিং, ১৯৫০-এর দশকের সবচেয়ে বড় তারকা দিলীপ কুমারকে। অভিনয় নিয়ে দিলীপ কুমার ছিলেন খুবই মনোযোগী শিল্পী; যাকে বলে অন্তর থেকে পারফেকশনিস্ট। অভিনয়ে নিজের শতভাগ সামর্থ্য ঢেলে দিতে চাইতেন। তাই সাধারণত কোনো সময়ে একটি ছবিতেই কাজ করতেন। পিয়াসার নায়কের কাছ থেকে ঠিক এমন নিষ্ঠাই চেয়েছিলেন গুরু দত্ত।


পরিকল্পনামতো গুরু দত্ত গেলেন দিলীপ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাকে পিয়াসার কাহিনী শোনালেন। দিলীপ কুমারও প্রাথমিকভাবে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি ছবির জন্য দেড় লাখ রুপি পারিশ্রমিকের দাবি করলেন। কিন্তু গুরু দত্ত তাকে পারিশ্রমিক কমাতে অনুরোধ করলেন। কারণ ছবির জন্য এরই মধ্যে কিছু শুটিং করেছিলেন, যেগুলো বাতিল করতে হয়েছে। কারণে তার বেশকিছু অর্থ অপচয় হয়ে গেছে। অনুরোধের জবাবে দিলীপ কুমার বললেন টাকা-পয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে। এবার ছবির মুখ্য চরিত্রের জন্য দিলীপ কুমার প্রস্তুত এবং তার ঘনিষ্ঠ ডিস্ট্রিবিউটররা গুরু দত্তের ছবির আর্থিক বিষয়াদির দেখভাল করবেন। সম্ভবত এই শেষের বিষয়টি গুরু দত্তের পছন্দ হয়নি। তিনি দিলীপ কুমারকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে তারও নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউটররা আছেন এবং তিনি তাদের কাছে পিয়াসা নিয়ে কথা দিয়েছেন। সাথায়া সরণের টেন ইয়ারস উইথ গুরু দত্ত বইয়ে আবরার আলভি বলেছেন, সেদিন গুরু দত্ত দিলীপ কুমারকে বলেন, আমি আপনার কাছে আমার ছবি বিক্রি করতে আসিনি। ছবি বিক্রি আমি নিজেই করতে পারব। আমি আপনার কাছে এসেছি পরিচালক হিসেবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আপনি কাজ করলে আমি ভালো একটা সিনেমা নির্মাণ করতে পারব। আপনার উপস্থিতি ছবিতে বাড়তি মর্যাদা যোগ করবে। গুরু দত্তের কথায় সে সময়ের সবচেয়ে বড় তারকা দিলীপ কুমার কিছু মনে করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। দিলীপ কুমার গুরু দত্তের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা পরবর্তী সময়ে আর কোথাও উল্লেখ করেননি। কিন্তু সে সময় দিলীপ কুমার গুরু দত্তকে কথা দিয়েছিলেন যে পরদিন থেকে তিনি শুটিংয়ে হাজির থাকবেন।


পরদিন পিয়াসা ছবির মহরতের জন্য সবাই প্রস্তুত। ছবির পুরো টিম দিলীপ কুমারকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছে। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু দিলীপ কুমারের দেখা নেই।

গুরু দত্তের প্রডাকশন কন্ট্রোলার গুরুস্বামী বলেছেন, আমি নিজে গিয়েছিলাম দিলীপ সাবকে নিয়ে আসতে, কিন্তু তার বাসায় গিয়ে দেখি তিনি নেই।


গুরুর ভাই দেবী দত্ত স্মৃতিচারণ করে বলেন, তাকে (দিলীপ কুমার) মহরতের জন্য আসতে হতো এপি কার্দার স্টুডিওতে। একই কম্পাউন্ডে ছিল বিআর চোপড়ার (প্রযোজক-পরিচালক) দপ্তর। দিলীপ সাব সেখানে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। বিআর চোপড়া সাব গুরু দত্তের মধ্যে একটা নীরব রেষারেষি ছিল। দিলীপ সাব সেখানে বসে বিআর চোপড়া সাবের ছবির নয়া দরের চিত্রনাট্য নিয়ে আলাপ করছিলেন। অন্যদিকে পিয়াসার মহরতের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। গুরু দত্ত এবার সেখানে লোক পাঠালেন দিলীপ কুমারকে নিয়ে আসতে। দিলীপ সাব জানালেন, তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছেন। কিন্তু তার পরও দিলীপ কুমার সেখান থেকে উঠলেন না। মধ্যাহ্নভোজের সময় গুরু দত্ত আরো দুজনকে পাঠালেন। বেলা ৩টা নাগাদ গুরু দত্ত নিজেই ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং প্রথম শটও সম্পন্ন করলেন।


অভিনেতা হিসেবে গুরু দত্ত সবসময়ই তার প্রতিভাকে অবজ্ঞা করেছেন। তার যে ছবিগুলোতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেগুলোতে তিনি সবসময়ই ছিলেন দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পছন্দ এবং অবশ্যই অনিচ্ছা সত্ত্বেও। সিনেমাটোগ্রাফার গুরু দত্তের টিমের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভিকে মূর্তি স্মরণ করেছেন, অভিনেতা হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি তার অভিনয়কে যথেষ্ট মূল্যায়ন করার সুযোগ পেতেন না। তাই দায়িত্বটা ছিল আমার আবরারের কাঁধে।

প্রথম শট দেয়ার পরও গুরু দত্ত নতুন করে অন্য কোনো অভিনেতাকে চুক্তিবদ্ধ করার কথা ভাবছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, ট্র্যাজিক কবির জটিল চরিত্রটি করার মতো সামর্থ্য তার নেই। তার মনে হয়েছিল, আরো দক্ষ একজন অভিনেতাকে দরকার।


পরবর্তীকালে এক সাক্ষাত্কারে দিলীপ কুমার বলেছিলেন, তিনি পিয়াসা ছবিটি করেননি। কারণ এর চরিত্রটি তার স্মরণীয় কাজ দেবদাসের চরিত্রটির কাছাকাছি। এর বাইরে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে দিলীপ কুমার কখনো কিছু বলেননি। এটা সত্য যে সেই মহরতের দিন দিলীপ কুমার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আর তা নাহলে পিয়াসা হয়তো ভিন্ন রকম কিছু হতো। কিন্তু বলতেই হয়, গুরু দত্ত যেভাবে বিজয়ের চরিত্রটি তুলে ধরেছেন তাতে অন্য কাউকে এখন আর তার বিকল্প কল্পনা করাটা কঠিন। চরিত্রটিতে গুরু দত্ত তার প্রতিভার সবটুকুই উৎসর্গ করেছিলেন। গুরু দত্ত যেন সত্যিই সেই হূদয় ভাঙা কবি বিজয় হয়ে উঠেছিলেন।

দিলীপ কুমার প্রত্যাখ্যান করার পর চরিত্রটি করার সাহসী সিদ্ধান্ত গুরু দত্তকে ফল দিয়েছিল। কারণ এটি বলউডের সর্বকালের সেরা পারফরম্যান্সের একটি বলে স্বীকৃত। দিলীপ কুমারের জীবনীকার বানি রুবেন লিখেছেন, গুরু দত্ত প্রকৃতপক্ষে যা করেছিলেন...পুরো চলচ্চিত্র দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি দিলীপ কুমারের একটি চরিত্র একেবারে নতুন এক অভিনেতাকে দিয়েছেন এবং তিনি একটা সুপারহিট ছবি বানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন