অভিমত

প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির অপসংস্কৃতি

এম আর খায়রুল উমাম

বিশ্বব্যাপী মানুষ নিজের যেকোনো ১০ টাকার কাজ টাকায় করতে চেষ্টা করে। আবার দশদিনের কাজও সাতদিনে শেষ করতে চায়। কাজ করতে গিয়ে গুণগত মানের সঙ্গেও তারা কোনো আপস করে না। প্রতি ব্যক্তির মধ্যেই এমন চারিত্রিক গুণ বিরাজ করে থাকে। মানুষ সাধারণভাবেই নিজের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি কাজের গুণগত মান রক্ষা করে নির্ধারিত সময় ব্যয়ের রাশ নিজের দিকে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকে। বিবেকবান মানুষ মাত্র সর্বক্ষেত্রেই কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে আমরা ব্যক্তিগত জীবনে গুণের অধিকারী হলেও আমাদের জাতীয় জীবনে গুণ অনুপস্থিত। জাতীয় জীবনের সর্বত্র দেখা যায় ১০ টাকার কাজ ১০০ টাকায় করার এবং এক বছরের কাজ পাঁচ বছর ধরে করার অভ্যস্ততা। আমাদের কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে এবং ব্যয়ে শেষ হয় না। মেগা প্রকল্পই শুধু নয়, সব প্রকল্পই পথে অতীতেও চলেছে এবং এখনো তা নীতিতেই পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য ক্রয়ের টেন্ডারে ১০০ টাকার দ্রব্য হাজার টাকায় কেনার প্রতিযোগিতা সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে একের পর এক মানুষ কীভাবে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চলেছে। কেউ কারো পেছনে থাকতে চায় না। সবাই নিজেকে সবার আগে রাখতে চায়। দৌড় প্রতিযোগিতায় যার কপালে রিকশা জুটছে, সেও হেরে যেতে চায় না যন্ত্রচালিত যানের কাছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, আইন, সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসনও আজ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

আমাদের প্রকল্পে দফায় দফায় ব্যয় সময় বাড়ানোর সংস্কৃতি চলমান। এমনকি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করতে গিয়েও আমরা দায়িত্ব নিয়ে পথ থেকে সরে আসিনি। ঋণ অনুদানের অর্থ নয়ছয় করতে করতে নিজের টাকাকে মনে হয় অন্যের টাকা তাই অবস্থা থেকে বের হওয়ার ন্যূনতম প্রচেষ্টাও দেখা যায় না। পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা এবং নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। এখন পর্যন্ত তিন দফায় ব্যয় সময় বাড়িয়ে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে। এখন আবার আলোচনা চলছে ব্যয় না বাড়িয়ে শুধু সময়টা ২০২২ সালের জুন করার। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে প্রথম দফায় হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেড়েছে। দোহাজারী- ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প প্রাথমিকভাবে হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফায় তা ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ২০২২ সালের জুনে শেষ করার অবস্থায় আছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের জুনে শেষ করার কথা। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে হাজার ৩৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল, যা করোনাকালে অতিক্রান্ত হয়ে  গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প ২০০৬ সালে হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২ সালের জুনে শেষ করার কথা। ২০১৬ সালে অসমাপ্ত প্রকল্পের উদ্বোধন হলেও ব্যয় হয়েছে হাজার ৮১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। মেগা প্রকল্পের মধ্যে মেট্রোরেল, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতার বাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। এসব প্রকল্প শেষ হতে অনেক বাকি, তাই সময়ই বলবে কী হবে?

প্রকল্পের ব্যয় সময় বৃদ্ধির সংস্কৃতি পুরনো। বর্তমান সময়েই যে কাজ চলমান তা নয়, অতীতের প্রকল্পগুলোও সংস্কৃতির বাইরে ছিল না। ৬৯ কোটি টাকার জিয়া সার কারখানা হাজার ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শেষ করা হয়েছে। ৬০০ কোটি টাকার চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি হাজার ৬৫০ কোটি টাকায় শেষ করা হয়। একইভাবে কোটি টাকার মেঘনা-ধোনাগোছা প্রকল্পে ১৫০ কোটি টাকার ওপর ব্যয় হয়েছে। ৩০-৪০ কোটি টাকার তিস্তা প্রকল্পের নির্মাণকাজ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ছাড়িয়ে গিয়ে এখনো চলমান। দেশের মানুষ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রকল্পগুলো লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। সেচ প্রকল্পগুলো লক্ষ্যমাত্রার সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি। মিল-কারখানা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। নির্মাণকাজ কাঙ্ক্ষিত জীবনকাল পায়নি। জনকল্যাণের নামে অনেক প্রকল্প এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করেছে। যশোর অঞ্চলের মানুষের দুঃখ হিসেবে খ্যাত ভবদহ আজ প্রায় ৪০ বছর ধরে জলাবদ্ধ। পোল্ডার আর স্লুইচ গেট নির্মাণ করে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করতে গিয়ে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এখন এই পানিবন্দি মানুষ বাঁচাতে প্রতি বছর নতুন নতুন প্রকল্প করে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। আবার অনেক প্রকল্প আছে, যার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণ করার আগেই সেই প্রকল্প- নামে নতুন করে শুরু হয়ে  গেছে। টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রকল্প কেনাকাটা আর কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের মধ্যেই সীমিত করে ফেলা হয়েছে।

দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নত অনেক দেশের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। আরো নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন। পাশাপাশি  পেশাজীবীদের পেশাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার মান বিবেচনায় বিশ্বে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার তালিকায়ও অনেক নিচের দিকে আমাদের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষকদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। রেজিস্ট্রারদের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের দায়িত্বে আগামীতে ব্যবসায়ী বা প্রশাসনের লোক দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দলীয় নিগড়ে বাঁধা উপাচার্য পদপ্রাপ্তির তদবির এখন আর সাধারণ মানুষকে অবাক করে না। সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা মানসম্মত শিক্ষাকে বেহাল করেছে। শিক্ষার মানহীনতাই প্রকল্পের কারিগরি বিষয়ে বিদেশনির্ভরতার অন্যতম কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা কারো অনুগ্রহের দান নয়। দুর্ভাগ্য এই যে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারল না। ব্যক্তি মানুষকে দীর্ঘ পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে বের করে স্বাধীন মানসিকতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলো। বহুজনের কল্যাণের মধ্যে নিজের কল্যাণ, তা মানুষ বিশ্বাস করল না। নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে একটা অংশ নিবেদিত হলো আর সাধারণ জনেরা নিষ্ক্রিয় হয়ে দর্শক হয়ে গেল।

স্বাধীন দেশে প্রকল্পের ব্যয় সময় বৃদ্ধির অপসংস্কৃতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। নির্ধারিত সময় ব্যয়ে প্রকল্প শেষ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আগ্রহী প্রকল্প পরিচালকদের মধ্যে থেকে ইচ্ছুক ব্যক্তি, যিনি ন্যূনতম ৮০ শতাংশ লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণ করে প্রকল্প শেষ করার দুই বছরের মধ্যে লাভজনক অবস্থা দেখাতে পারবেন, এমন কাউকে দায়িত্ব দিলে চলমান অপসংস্কৃতিমুক্ত হওয়া যেতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা হলে, রাজনীতিতে বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিচিন্তা যুক্ত করা হলে, সর্বোপরি নিজেদের স্বাধীন মানসিকতাসম্পন্ন করা হলে মাটি মানুষের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে এবং দেশের মানুষ অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত হবে।

 

এম আর খায়রুল উমাম: প্রাবন্ধিক

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন