আলোকপাত

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অংশীজনদের ভূমিকা?

মোহাম্মদ জমির

জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি একদিনের ভার্চুয়াল ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিটে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্বনেতাদের প্রতি শূন্য কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন না হওয়া অবধি জরুরি অবস্থার কথা বলেছেন। অন্যথায়, বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ কমিয়ে আনায় কার্যক্রমগুলোতে গতি আনতে এবার ভার্চুয়ালিই অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট। ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই ভার্চুয়াল সম্মেলনে ৭০ জন বৈশ্বিক নেতৃত্বসহ মোট ১৯৬টি দেশ অংশগ্রহণ করে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে পাঁচ বছর আগে প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না হয় তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। সেই প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সেই লক্ষ্য পূরণে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে তা অপর্যাপ্ত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ উপেক্ষাও করা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বিশ্বসম্প্রদায় যদি তাদের গতিপথ না বদলায় তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা শতাব্দীতে বিপর্যয়করভাবে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আরো উল্লেখ করেছেন, জি-২০ তালিকায় থাকা দেশগুলোই সিংহভাগ কার্বন দূষণের জন্য দায়ী, অথচ তারা তাদের উদ্ধার প্যাকেজের ৫০ শতাংশের বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি নয় বরং জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় করছে। তিনি এখানেও জোর দিয়েছিলেন যে বিমান শিপিংয়ের মতো মূল কার্বন নির্গমন ক্ষেত্রগুলোরও এবার কার্বন নিঃসরণ প্রশমনের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন রূপান্তরকারী পরিকল্পনা উপস্থাপন দরকার। সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে বিষয়টিকে বারবার পুনরাবৃত্তি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পদক্ষেপগুলো নতুন কর্মসংস্থান, উন্নত স্বাস্থ্য টেকসই অবকাঠামোর অনুঘটক হতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃষ্টিভঙ্গি সুইডেনের পরিবেশবাদী গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তরুণ পরিবেশবাদী বলেছেন যে জলবায়ুবিষয়ক পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই ভুল দিকনির্দেশনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য ফ্রান্সের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অংশীদার হিসেবে ছিল চিলি ইতালি। বিশ্বনেতৃত্বের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি প্যারিস চুক্তি সমর্থন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৃহত্তর প্রচেষ্টায় শামিল হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, শুধু বহুপাক্ষিকতার প্রতি অনুগত্য হয়ে ঐক্যের প্রতি জোর দেয়া সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা পারস্পরিক সুবিধা লাভ এবং সেরা ফলাফল অর্জন করতে পারি সব দেশের জনগণের উপকার করতে পারি। তিনি আরো বলেন, আমরা বিশ্বকে মর্মে অবহিত করেছি যে ২০০৫ সালের সঙ্গে তুলনায় ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির ইউনিটপ্রতি কার্বনডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ ৬৫ শতাংশের বেশি হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে চীন।

পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় আরো কিছু দেশের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গৃহীত প্রয়াসের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে আশার সঞ্চার করবে।

শুরুতে আমরা যুক্তরাজ্যের উদ্যোগগুলোর দিকে আলোকপাত করতে পারি। কেননা তাদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি আসন্ন কনফারেন্স অব দ্য পার্টির (কপ) সভাপতিত্ব করছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফোরাম। সম্মেলনটি ২০১২ সালের নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে। পাঁচ বছর আগে প্যারিস চুক্তির পর ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনটিই (কপ-২৬) হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো বৈঠক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে, ২০০৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশটির কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। যুক্তরাজ্য খুব সহজেই সে লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে। এমনকি, ১৯৯০ সালের তুলনায় যুক্তরাজ্য বর্তমানে ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যাই হোক, স্বাভাবিকভাবেই এটি ধরে নেয়া যায় যে ব্রেক্সিটের পর দেশটিকে নতুন করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণবিষয়ক মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। আর্থসামাজিক অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, ২০২১ সালে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটি শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার দিকে আরো বেশি জোর দেবে।

এদিকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতার কারণগুলো মোকাবেলায় যথেষ্ট আগ্রহের অভাব দেখায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন তখন নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং কীভাবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা যায়, সে সম্পর্কে চীনের সঙ্গে সংযোগ নির্মাণের চেষ্টা করে। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশ ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলোর কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং তারা ইইউর পরিকল্পনার সঙ্গে সর্বদা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেছে।

গত পাঁচ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গৃহীত লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখে অর্থনীতিবিদরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পর্যায়ে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে ২০০৭ সালে ইইউ নেতারা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ ২০২০ সাল নাগাদ ১৯৯০-এর মাত্রার চেয়ে ২০% কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে অগ্রসর হওয়ায় ২০১৮ সালে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২৩ দশমিক শতাংশ হ্রাস পায়। মজার বিষয় হচ্ছে, অতি-অর্জনের ফলে অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল যে প্রাথমিক লক্ষ্যগুলো সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২০৩০ সালের মধ্যে শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা সময়োপযোগী হয়নি।

ভারত কার্বন নিঃসরণের অন্যতম অনুঘটক। রাষ্ট্রটিও বিশ্বের কাছে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। ১২ ডিসেম্বর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে বলেন, ভারত অন্যতম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে মনোনিবেশ করেছে। অবস্থায় আগামীতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করবে তারা। ২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি কার্বন নিঃসরণ বর্জ্য হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাপান সুস্পষ্টভাবেই ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা এবং শূন্য কার্বন নির্গমন অর্জনের চেষ্টা করছে। যা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।

আলোচনার পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার নাম উল্লেখ করা দরকার, কারণ দেশটি শুধু জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম বৃহৎ উৎস নয়, একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বব্যাপী দশমিক শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। কৌশলগত বিশ্লেষকরা আরো উল্লেখ করেছেন, অস্ট্রেলিয়ানরা মাথাপিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের তুলনায় চার গুণ বেশি কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়বদ্ধ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও মনে হয় যে অস্ট্রেলীয়রা কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়গুলোতে গুরুত্ব সহকারে মনোযোগ দিচ্ছে না। ২০৩০ সাল নাগাদ দেশটি কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে সার্বিক অনুমানগুলো ইঙ্গিত দেয় যে ২০৩০ সাল নাগাদ তারা ১৬ শতাংশেরও কম কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমর্থ হবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা পুরো পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার আশপাশে অনেক ছোট ছোট দ্বীপের প্রতিবেশী রাষ্ট্র রয়েছে। অবস্থায় জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা সস্তা নবায়নযোগ্য, যেমন সৌরশক্তি, জিওথার্মাল, বায়োফুয়েল পুনর্নবীকরণযোগ্য সংস্থান থেকে প্রাপ্ত হাইড্রোজেন এবং বায়ুচালিত টারবাইন থেকে প্রাপ্ত শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন শক্তি বিপ্লবের সূচনা হতে পারে। তবে নতুন নবায়নযোগ্য শক্তি চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে: বিদ্যুৎ উৎপাদন, বায়ু এবং জল উত্তাপ/শীতলীকরণ, পরিবহন এবং গ্রামীণ (অফ-গ্রিড) শক্তি পরিষেবা।

তরুণদের পাশাপাশি দেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতায়াত জীবিকার জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবগুলোকে আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধরনের প্রভাব বিদ্যমান। আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিদ্যমান প্রভাবগুলোকে আমরা যদি এখন বুঝতে না পারি তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশন আবাসনের মতো মৌলিক অধিকারসহ মানবাধিকারের বিস্তৃত ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। আর তাই আমাদের গঠনমূলক আন্তঃঅঙ্গীকার প্রয়োজন।

 

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন