অভিমত

ঢাকা ৪.০: সম্ভাবনা ও লক্ষ্যনির্ভর উন্নয়ন

অরিজিৎ চক্রবর্ত্তী

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পাশাপাশি দ্রুত নগরায়ণের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশেই নগরগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী এবং নাগরিকদের আকর্ষণ করার জন্য একে অন্যের সঙ্গে এক ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের প্রতিযোগিতামূলক কৌশলের অংশ হিসেবে তারা নিজেদের স্মার্ট সিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছে।

বিষয়ে বিশদে আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের বুঝতে হবে স্মার্ট সিটি কী? একটি স্মার্ট সিটি একটি নগর অঞ্চল, যা সম্পদ সংস্থানগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিন তথ্য ব্যবহার করে। একটি স্মার্ট সিটিকে বিদ্যুৎ অন্যান্য জ্বালানির ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে এবং বিশেষত পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নগরটিকে বর্জ্য পরিচালনায় দক্ষ হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, এই জাতীয় শহরটির বেশির ভাগ ঘন তরল বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া উচিত। একটি স্মার্ট সিটির বায়ুুমণ্ডলে ন্যূনতম কার্বন নিঃসরণ করা উচিত এবং সামগ্রিক কার্বন নিঃসরণও হ্রাস করা উচিত।

বর্তমানে ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা দুই কোটির অধিক। বৃহত্তর ঢাকার আয়তন ৩০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি। শহরের জনসংখ্যা জন্মসূত্রে এবং পরিযানের ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাড়ছে। ঐতিহাসিকভাবে শহরটি প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন এবং এর অনেক ঐতিহ্যপূর্ণ স্থাপত্য রয়েছে। তবে এত বড়সংখ্যক জনসাধারণকে নাগরিক সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা একই গতিতে বাড়ছে না। তাই নগর প্রশাসনের উচিত প্রযুক্তিনির্ভর এক সামগ্রিক রূপান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এক ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সারা বিশ্বের বড় নগরগুলোও এর প্রভাবে প্রভাবিত।  চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই নতুন আঙ্গিকে ঢাকা নগরের রূপান্তরের পরিকল্পনা করতে হবে। বিশ্বমানের নগরগুলোর সমকক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে হয়ে উঠতে হবে এক যথার্থ ঢাকা .০। 

একটি স্মার্ট সিটির বাসিন্দাদের জন্য স্মার্ট বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।  শহরের ভবনগুলোকে আরো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে উৎসাহ দেয়ার পরিকাঠামো থাকতে হবে একটি স্মার্ট সিটিতে। সঙ্গে সঙ্গে নির্মীয়মাণ ভবনগুলোয় নতুন প্রজন্মের জ্বালানি ব্যবস্থা তার পরিমিত ব্যবহারোপযোগী পরিকাঠামো গড়ে তুলতে উৎসাহদানের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যুৎসাশ্রয়ী আলোকসজ্জা এই ভবনগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে বর্তমানে ঢাকায় গ্রিন বিল্ডিং স্পেসিফিকেশন ব্যবহার করে প্রচুর নতুন ভবন নির্মিত হচ্ছে। নির্মাণকারীদের এই প্রচেষ্টা ঢাকা নগরের অগ্রগতির পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

একটি স্মার্ট সিটির পরিবহন পরিকাঠামো সব প্রকার বাসিন্দাদের জন্য নির্মাণ করা উচিত। শহরের পরিবেশের কথা খেয়াল রেখে পথচারীদের এবং বাইসাইকেল আরোহীদের নিরাপদে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করার সুবন্দোবস্ত থাকা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর অনেক শহর সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক সরণি তৈরি করেছে, যাতে তাদের নাগরিকরা এই স্বাস্থ্যকর পরিবেশবান্ধব যাত্রা পদ্ধতি ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়। কিছু শহর বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে যাতায়াতের প্রযুক্তিনির্ভর প্লাটফর্ম ব্যবহারের পরীক্ষা শুরু করেছে। এই জাতীয় প্লাটফর্ম ব্যবহার করে কোনো বাসিন্দা একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে একটি বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে তার গন্তব্যে যাত্রা করতে পারেন। আরোহী গন্তব্যে পৌঁছে বাইসাইকেলটি কাছাকাছি নির্দিষ্ট স্থানে ফিরিয়ে দিতে পারেন। প্রযোজ্য ভাড়া বৈদ্যুতিন মাধ্যমের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মেটানো যায়। নগরের দূষণ কমাতে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যকর জীবনশৈলীতে অভ্যস্ত করতে ধরনের প্রকল্প রূপায়ণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

একটি স্মার্ট সিটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো একটি পরিবেশবান্ধব দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে সড়কগুলোয় মোটরযানের প্রবাহ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিচালনা করা উচিত। এক্ষেত্রে কম্পিউটারচালিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। সড়কের দক্ষ ব্যবহার এবং মোটরগাড়ির সুসংহত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা একটি স্মার্ট সিটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেক্ষেত্রেও প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব পরিবহন হিসেবে বিদ্যুত্চালিত মোটরযান যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিদ্যুত্চালিত মোটরযান প্রযুক্তি গত কয়েক বছরে প্রভূত উন্নতি করেছে এবং বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে সাশ্রয়ী হয়েছে। একটি স্মার্ট সিটিতে মোটরচালকদের -জাতীয় যানবাহন ব্যবহার করতে উৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক চার্জিং পয়েন্ট থাকা উচিত।

তদুপরি, নগর কর্তৃপক্ষের অন্যতম লক্ষ্য হলো নগরকে বিনিয়োগের পক্ষে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হিসেবে গড়ে তোলা। লক্ষ্য অর্জন করতে হলে নগরের তথ্যপ্রযুক্তি টেলিযোগাযোগ পরিকাঠামো আরো উন্নত করে তুলতে হবে। একটি সার্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও লক্ষ্যে অংশগ্রহণে আগ্রহী করতে হবে। ধরনের পরিকাঠামো সরকারি বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমেও নির্মাণ করা যেতে পারে। নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের বাসিন্দাদের জন্য এই পরিকাঠামোর সাহায্যে আরো নতুন পরিষেবা শুরু করতে পারে।  তবে খেয়াল রাখতে হবে যে সরকারি বেসরকারি যৌথ প্রকল্প সফল করতে হলে সব প্রকল্পে একটি সার্বিক স্বচ্ছতা প্রয়োজন। একটি স্মার্ট সিটির কর্তৃপক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বেই নগরের অপরাধের প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়ির অভ্যন্তরে এবং ইন্টারনেটের অনলাইন পরিবেশে এখন অনেক বেশি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। গার্হস্থ্য হিংসা, শিশু নির্যাতন, বয়স্কদের নিপীড়নমূলক অপরাধ অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটছে।  এসব অপরাধ ঘটছে বাড়ির বন্ধ দরজার ওপারে বা ঘরের ভেতরে, যা কেবল রাস্তায় পুলিশ টহল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তদুপরি ইন্টারনেটের অনলাইন পরিবেশে ঘটে চলা সাইবার ক্রাইমের মতন অপরাধ কোনো ভৌগোলিক সীমানা মানে না। ঢাকার মতো মহানগরে বহুসংখ্যক অধিবাসী ইন্টারনেটের অনলাইন পরিবেশে সময় কাটান এবং এদের অনেকে সাইবার ক্রাইমের ভুক্তভোগী। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। একটি স্মার্ট সিটির পুলিশি ব্যবস্থা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হওয়া উচিত। আর তা করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউ আজ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর সামনে এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা উপস্থাপন করেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় এখন কোনো অগ্রণী দেশীয় প্রতিষ্ঠানও আন্তর্জাতিক তথা বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে এই প্রবণতা ক্ষুদ্র আকারে হলেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেসব নব্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের সদর দপ্তর কোনো আন্তর্জাতিক নগরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগেই ঢাকা নগরকে প্রস্তুত হয়ে উঠতে হবে। হয়ে উঠতে হবে যথার্থ ঢাকা .০। মহানগরগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা নতুন নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। ঢাকা নগরকে সেই প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

[মতামত ব্যক্তিগত]

 

অরিজিৎ চক্রবর্ত্তী: প্রাইসওয়াটারহাউজকুপার্সের একজন পার্টনার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন