ইস্তানবুল-তেহরান-ইসলামাবাদ রেল নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে উষ্মা বাড়াচ্ছে

বণিক বার্তা ডেস্ক

ইস্তানবুল-তেহরান-ইসলামাবাদ (আইটিআই) রেল নেটওয়ার্ক প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ২০০৯ সালে। এর প্রায় এক যুগ পর চলতি বছরেই বাণিজ্যিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে রেল নেটওয়ার্কটি। দক্ষিণ এশিয়া ইউরোপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রেল নেটওয়ার্ককে ঘিরে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পক্ষ নানা পরিকল্পনাও নিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত উদ্যোগ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে যাচ্ছে চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাস্তবায়নের পথকে অনেকটাই সুগম করে দিতে যাচ্ছে রেল নেটওয়ার্ক। চীন যে অদূর ভবিষ্যতেই রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইটিআই নেটওয়ার্ক সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কর্মকর্তারাও।

তবে শেষ পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বড় ধরনের উষ্মার কারণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্পের বাস্তবসম্মততা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। তবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভূরাজনৈতিক বিষয়াদিই উষ্মার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

গত মাসেই তুরস্ক, ইরান পাকিস্তানের রেল খাতসংশ্লিষ্টরা নেটওয়ার্ক পুরোদমে চালু করে দেয়ার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছেন। হাজার ৫৪০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর মোট পরিধির ছয় ভাগের এক ভাগের চেয়েও বেশি। এর মধ্যে রেলপথটির তুরস্ক অংশের দৈর্ঘ্য হাজার ৯৫০ কিলোমিটার। এছাড়া ইরান পাকিস্তান অংশের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে হাজার ৬০০ হাজার ৯৯০ কিলোমিটার। বিশ্লেষক পর্যবেক্ষকদের মতে, চালু হলে প্রকৃত অর্থেই আঞ্চলিক বাণিজ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে রেলপথটি।

এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সমুদ্রপথে ইস্তানবুল থেকে ইসলামাবাদে পণ্য পরিবহনে সময় লাগে ২১ দিন। রেলপথ চালু হলে তা নেমে আসবে ১০ দিনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেল নেটওয়ার্কটি চীনের বিআরআই প্রকল্পের অংশ না হলেও একপর্যায়ে এর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। ইসলামাবাদের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের এমএল- প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের স্বায়ত্তশাসিত জিনজিয়াং উইঘুর প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হবে আইটিআই রেল নেটওয়ার্ক। চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) সবচেয়ে বড় উপাদান হতে যাচ্ছে এমএল- প্রকল্প। ৬৮০ কোটি ডলারের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হতে সময় লেগে যাতে পারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

মনে করা হচ্ছে, আইটিআই প্রকল্প বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনকে আরো প্রভাবশালী করে তুলবে। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে এশিয়ার মোড়ল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে চীন।

অথচ চীনের বিআরআই পরিকল্পনাকে মোকাবেলার জন্য একসময় আইটিআই রেল নেটওয়ার্ককেই কাজে লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছিল। ২০১৭ সালের মার্চে আইটিআই-ডিকেডি-ওয়াই প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের আগে ইউরোপে কানেক্টিভিটি তৈরির এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে ভারত। এজন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ঢাকা থেকে ইস্তানবুল পর্যন্ত রেল সংযোগ তৈরির এক প্রস্তাব দেয় দেশটি। সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে শুরু হয়ে কলকাতা-দিল্লি-অমৃতসর-লাহোর-ইসলামাবাদ-জাহেদান-তেহরান হয়ে ইস্তানবুল পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্কটি স্থাপন করার প্রস্তাব ছিল ভারতের। প্রস্তাব অনুযায়ী, পরে রেল নেটওয়ার্কে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনকে যুক্ত করা হবে। এছাড়া আফগানিস্তান পাকিস্তানের কোয়েটা রেলস্টেশন হয়ে এবং নেপাল বীরগঞ্জ (পারসা জেলা) থেকে কলকাতা হয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারবে বলেও সে সময় জানানো হয়। নিয়ে ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নিয়ে ভারতের আহ্বানে বৈঠক আয়োজন করা হলেও বিষয়টি এখন পর্যন্ত তেমন একটা এগোয়নি।

তবে শেষ পর্যন্ত আইটিআই রেল নেটওয়ার্ক যে শেষ পর্যন্ত বিআরআইর বর্ধিত অংশ হিসেবেই কাজ করতে যাচ্ছে সে বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চিত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বেইজিং ইরানের পরিবহন অবকাঠামো এবং ইসিও (ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে ১০ দেশের জোট ইকোনমিক কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন) জোটভুক্ত দেশগুলোকে বিআরআইর অংশ হিসেবেই দেখছে। সংকট যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ধরনের বিকল্প বাণিজ্যিক পথগুলো অনেক মূল্যবান লাভজনক হয়ে উঠতে পারে।

আইটিআইর সঙ্গে এমএল- যুক্ত হলে শুধু নেটওয়ার্ক দিয়েই যে চীন তুরস্কের প্রথম রেল যোগাযোগ তৈরি হবে, তা- নয়। ১৯ ডিসেম্বর একটি ট্রেন চীনের শাংসি প্রদেশের শিয়াংয়ে এসে পৌঁছে। তুরস্ক থেকে যাত্রা করে ট্রেনটি ওই পর্যন্ত পৌঁছার আগে জর্জিয়া, আজারবাইজান হয়ে ফেরি করে কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়েছে। এরপর কাজাখস্তান হয়ে জিনজিয়াংয়ের উত্তর-পূর্বে শিয়ানে এসে থেমেছে ট্রেনটি। বাকু-তিবলিসি-কারস হয়ে ট্রান্স কাস্পিয়ান ইস্ট-ওয়েস্ট মিডল করিডোরে গড়ে উঠেছে রেলওয়ে রুটটি।

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে চীন উভয় রুটকেই ব্যবহার করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে ইস্তানবুল-শিয়ান এবং আইটিআই রেল নেটওয়ার্কদুটি রেলপথেই চীনের অর্থনৈতিক ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের প্রতিফলন দেখা যাবে বলে ধারণা তাদের। অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সামনেও অন্যতম প্রধান ইউরেশীয় পরিবহন হাব হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

রেলপথটি ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকেও। কারণ এর ফলে ইরানেরও মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ এড়িয়ে যাওয়ার বড় একটি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে ইসিওভুক্ত দেশগুলো বাণিজ্য পরিচালনার জন্য স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে থাকে। কারণে পথ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনায় ডলারের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না তেহরানকে।

ইরান, তুরস্ক পাকিস্তানের বাইরে ইসিও জোটভুক্ত অন্য দেশগুলো হচ্ছে আজারবাইজান, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান তুর্কমেনিস্তান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালানো থেকে ইরানকে বিরত রাখা একপ্রকার অসম্ভব করে তুলবে নতুন রেলপথটি। এছাড়া ধরনের বৃহদায়তন প্রকল্প দেশটির অর্থনীতিতে একদিকে যেমন উদ্দীপকের কাজ করবে, তেমনি দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

তেহরানকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল চীন। সেক্ষেত্রে আইটিআইর মতো প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রকে আরো ক্ষুব্ধ করে তোলার আশঙ্কাই এখন বেশি।

আইটিআই রেল নেটওয়ার্কের জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে নিরাপত্তা ইস্যু। রেলপথ-সংশ্লিষ্ট এলাকার বড় একটি অংশে সন্ত্রাসী জঙ্গি উৎপাত অনেক বেশি। বিশেষ করে রেলপথটির ইরান পাকিস্তানের পশ্চিম বালুচিস্তান অংশে সন্ত্রাসবাদীদের আনাগোনা অনেক বেশি। এছাড়া স্বাধীনতাকামী বালুচদের সঙ্গে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও নিয়মিত সংঘর্ষ ঘটছে। সেক্ষেত্রে চালু হয়ে যাওয়ার পর আইটিআই নেটওয়ার্ক সন্ত্রাসীদের জন্য সহজ টার্গেটে রূপ নেয়ার শঙ্কাও রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন