পিআরআই ও বণিক বার্তা অনলাইন বৈঠক

নিরাপত্তা ও সুষুম পরিবেশ পেলে নারীরা অর্থনীতিতে আরো বড় ভূমিকা রাখবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছেন নারীরা। উদ্যোক্তা হিসেবেও নারীদের ওপর এখনো আস্থা রাখতে পারছে না ব্যাংকগুলো। যদিও যেকোনো বিচারে পুরুষদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তারা অনেক বেশি সফল সৃজনশীল। সামাজিক মনস্তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কারণেই দেশের নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার পরিবর্তে নারীরা এখনো অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছেন। গত কয়েক দশকে দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। কিন্তু করোনা মহামারী তা আবারো বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিজিটাল পেমেন্ট প্রযুক্তিগত জ্ঞান কম থাকার কারণে আর্থিক লেনদেনে পিছিয়ে পড়ছেন নারীরা।

বণিক বার্তা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত অনলাইন বৈঠকে আর্থিক লেনদেনে লিঙ্গ বৈষম্যের সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে। বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অনলাইন বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ডাক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। আর্থিক লেনদেনে জেন্ডার অসমতা দূরীকরণে প্রযুক্তির ভূমিকা শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডব্লিউসিসিআই) সভাপতি সেলিমা আহমাদ এমপি, বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক, ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কেএএম মোর্শেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির, বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমুন্নয়ের ইমেরিটাস ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী। সভাপতির বক্তব্য রাখেন পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক। উপস্থাপনায় তিনি বলেন, কর্মবাজারে নিয়োজিত নারীদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিম্ন বেতনে কাজ করেন। নারীদের ব্যাংকিং খাতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। একইভাবে আর্থিক ব্যাংকিং খাত বিষয়ে জ্ঞান না থাকায় নারীদের নিজেদের মধ্যেও এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। এটি সার্বিকভাবে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তানিয়া হক বলেন, দেশে ব্যাংক হিসাবধারীদের ৬৫ শতাংশ পুরুষ। নারীদের হার ৩৫ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে কম্পিউটারে দক্ষতার হার ৪৪ শতাংশ। নারীদের মধ্যে হার ২৫ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছেন নারীরা। এক্ষেত্রে পুরুষদের হার ৩৬ শতাংশ নারীদের হার ১৬ শতাংশ। 

প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে ডাক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, নারীরা নিরাপত্তা পরিবেশ পেলে যে কাজ করতে পারেন তা অভাবনীয়। আজকে বাংলাদেশ যে পরিস্থিতিতে আছে, ১০ বছর পর তা থাকবে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজই হলো আমাদের ভিত্তি। আমাদের সমাজ আবারো মায়েদের পায়ের নিচেই যাচ্ছে। আমাদের মায়েরা ঘর থেকে বের হওয়া শিখেছেন। এখন তাদের শিকল দিয়ে বেঁধেও ঘরে ঢোকানো যাবে না।

সময় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো প্রথাগতভাবে পশ্চাত্পদ চিন্তা করে বলে অভিযোগ করেন মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ব্যাংকারদের কাছে হাজার কোটি টাকার মেধার মূল্য পয়সাও নেই। যে জমি বা বাড়ি জামানত দিতে পারে ব্যাংক তাকেই ঋণ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে, এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধন্যবাদ।

মোস্তাফা জব্বার বলেন, ব্যাংকগুলো বড় রাঘববোয়ালদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়। কিন্তু ব্যাংকারদের মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের ব্যবসা-বাণিজ্য বড়দের কাছে থাকবে না। বড় ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করার কথাও আমরা জানি। কিন্তু ছোট নারী উদ্যোক্তারা কোনোদিন দেশ থেকে অর্থ পাচার করবেন না। বরং মেয়েরা নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে ভবিষ্যতের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেবেন।

বিডব্লিউসিসিআই সভাপতি সেলিমা আহমাদ এমপি বলেন, নারীকে সব পরিবার সমান সুযোগ সুবিধা দেয় না। কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার। নারী উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। নারী উদ্যোক্তারা এখন অনলাইনে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারছেন। যে ব্যাংকের নারীদের অর্থায়ন করার অঙ্গীকার আছে, তারা সফলও হচ্ছে।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, নারীরা করে বেশি কিন্তু পান কম। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্তত ১০ শতাংশ নারী গ্রাহককে ঋণ দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হলেও সেটি এখনো শতাংশে সীমাবদ্ধ। এজন্য নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বিশেষ নির্দেশনা দরকার। প্রণোদনার অর্থ বিতরণের জন্য পোশাক খাতের সব কর্মীর এমএফএস হিসাব চালু করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাস পর সে হিসাবগুলোয় লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, যখন যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সফলভাবেই তা থেকে উত্তরণ করতে পেরেছে। ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। তার পরও যেকোনো পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ বা সুপারিশ এলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা অবশ্যই বিবেচনায় নেবে।

সামাজিক মনস্তত্ত্বের কারণেই আর্থিক লেনদেনে নারীরা পিছিয়ে পড়ছেন বলে মন্তব্য করেন ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কেএএম মোর্শেদ। তিনি বলেন, সামাজিক মনস্তত্ত্ব হলো নারীরা কেন চাকরি করবেন, কিংবা তারা কেন উদ্যোক্তা হবেন, তারা কেন বাজারে যাবেন? আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে মনস্তত্ত্ব থেকে জাতিগতভাবে বের হয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রযুক্তিতে নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে অনেক সংকটই কেটে যাবে। কেননা মানুষ বৈষম্য করতে পারলেও যন্ত্র বৈষম্য করতে পারে না।

ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবধারীদের ৬১ শতাংশই নারী বলে জানালেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, ব্যাংকারদের বড় অংশ পুরুষ। কারণে নারীদের অনেকেই তাদের কাছে গিয়ে সুখ-দুঃখের গল্প শেয়ার করতে পারেন না। নারী ব্যাংকারের সংখ্যা বাড়লে সমস্যা কেটে যাবে। ব্যাংকিং খাতে অদূর ভবিষ্যতে ভয়েস ব্যাংকিং, ফেস ব্যাংকিং, ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যাংকিং আসবে। এগুলো আসলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।

বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর বলেন, বিকাশের কোটি ১০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা অনেক এগিয়ে এসেছেন। নারীদের সামনে এগোনোর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

ছোট ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কথা ভাবার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, নারীদের ঘরেও সম্মান দিতে হবে। আস্থা তাদের ওপর রাখতে হবে, নারীরাও উদ্যোক্তা হতে পারবেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বেশির ভাগ পরিবারে নারীরাই হলেন প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা বা সিএফও। ঘরের আয়-ব্যয়ের হিসাব তারাই রাখেন। এক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতার সঙ্গেই পরিস্থিতির সামাল দেন। ঘরে যারা সফল, তারা বাইরেও সফল হতে পারবেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমুন্নয়ের ইমেরিটাস ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী আহ্বান জানিয়ে বলেন, গ্রাহকরা কোন প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করবেন, সেটি যাতে সরকার থেকে ঠিক করে দেয়া না হয়।

সভাপতির বক্তব্যে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দিতে হবে। ব্যাংকগুলো এজেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের বিষয়টিও ভাবতে পারে। এতে আর্থিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে।

তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের নারী গ্রাহকদের খেলাপি ঋণ শতাংশেরও কম। নারীদের ঋণ দিলে সেটি যেকোনো ব্যাংকের জন্যই ভালো। ঋণ বিতরণের জন্য ন্যাশনাল ক্রেডিট প্লাটফর্ম করা সম্ভব হলে সেটি সমাজ পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন