করোনার ৯ মাস

বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের ৬ হাজার কাঁকড়া খামার

আলী আকবর টুটুল, বাগেরহাট

মার্চে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় চীনে কাঁকড়া রফতানি। পাশাপাশি দেশের বাজারে কমে যায় দাম। অবস্থায় গত নয় মাসের টানা লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের প্রায় ছয় হাজার কাঁকড়া খামার। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছর আরো অনেক খামারি কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দেবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক খামারি ব্যাংক এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোনো রকম খামার বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দেশের বাজারে দাম না পাওয়ায় তা বিক্রি করতে পারছেন না। এজন্য দিনের পর দিন বাড়ছে ঋণের বোঝা। যদিও মৎস্য বিভাগ বলছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ক্ষতিগ্রস্ত হাজার ৬৩ জন কাঁকড়াচাষীকে সহায়তা দেবে সরকার। খামারিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারির তুলনায় সরকারের সহায়তা নিতান্তই কম।

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় হাজার ৮৫৯টি কাঁকড়া খামার রয়েছে। এসব খামারের সঙ্গে যুক্ত চাষীর সংখ্যা হাজার ৬৭০ জন। যদিও বেসরকারি হিসেবে জেলায় কাঁকড়া খামারের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হাজার ৬২৯ টন কাঁকড়া রফতানি করা হয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সে চিত্র। এখন টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে খামারিদের।

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামের কাঁকড়াচাষী পিনাক দাস বলেন, ১১ বিঘা জমিতে আমার চারটি খামার রয়েছে। লাখ টাকা পুঁজি হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। বর্তমানে খামার বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু ব্যাংক দাদনদারদের চাপে বাড়িতে থাকতে পারছি না।

কাঁকড়া চাষে ৪৬ লাখ টাকা পুঁজি হারিয়ে দিপঙ্কর মজুমদার এখন পাগলপ্রায়। কীভাবে দেনা পরিশোধ করবেন তা নিয়ে রয়েছেন শঙ্কায়। রফতানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা অধিকাংশ কাঁকড়াই মরে যায়। এজন্য চরম লোকসানে পড়েন তিনি।

দিপঙ্কর বলেন, চিংড়ি চাষে নানা প্রকার রোগবালাইয়ের কারণে তেমন লাভ হচ্ছিল না। পরে ২০১৮ সালে কাঁকড়া চাষ শুরু করি। লাভও ভালো হতে থাকে। এক পর্যায়ে ২০১৯ সালের শেষ দিকে বড় আকারে কয়েকটি কাঁকড়া খামার করি। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। রফতানি বন্ধ দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মতো বিক্রি করতে পারিনি। এক পর্যায়ে পুকুরেই কাঁকড়া মরে যায়। করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে ধারদেনা করে আবারো চাষ শুরু করি। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে আমাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না।

শুধু দিপঙ্কর মজুমদার পিনাক নয় রামপাল, মোংলা বাগেরহাট সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কাঁকড়াচাষীদের একই অবস্থা। কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও স্বাভাবিক ঋণের দায়ে ঘরে থাকতে পারছেন না তারা। আর যারা লোকসান টেনেও কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবস্থাও তথৈবচ। অবস্থায় চীনে সরাসরি কাঁকড়া রফতানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বিনা সুদে ঋণ দিয়ে শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।

বাগেরহাটের কাঁকড়াব্যবসায়ী সাধন কুমার সাহা বলেন, রফতানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রয় হয়, যা প্রত্যেক গ্রেডে থেকে ৭০০ টাকা কেজিতে কমেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল হাজার ২০০ টাকা, সে কাঁকড়া বর্তমানে ৮০০ টাকা। ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল হাজার টাকা তা বর্তমানে ৬০০ টাকা, ১৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৮০০ টাকা এখন তা ৪০০ টাকা, ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও পড়তে হয় লোকসানে।

বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস বলেন, সারা দেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশির ভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রফতানি করা হতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে রফতানি বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষী ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে বাগেরহাটের চাষীদের শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ছয় হাজার কাঁকড়া খামার। চীনে কাঁকড়া রফতানিসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এসব চাষী নিঃস্ব হয়ে যাবেন।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা . খালেদ কনক বণিক বার্তাকে বলেন, বাগেরহাটে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রফতানি হতো। এর মধ্যে চীনেই রফতানি হয় ৮০ শতাংশ। চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বন্ধ হয়ে যায় কাঁকড়া রফতানি। এতে চরম বিপাকে পড়েন চাষীরা। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। অবস্থায় আমরা চাষীদের ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিচ্ছি। সরকারিভাবে বাগেরহাটের হাজার ৬৩ জন খামারিকে প্রণোদোনা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে সরাসরি চীনে কাঁকড়া না গেলেও থাইল্যান্ড হয়ে চীনে কাঁকড়া রফতানি হওয়ায় দাম পাচ্ছেন না চাষীরা। এতে লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন