চলতি বিশ্ব

কভিডসৃষ্ট নীরব আর্থিক সংকট ও ২০২১ সালের অনিশ্চয়তা

কারমেন এম রেইনহার্ট

বেশ আগে থেকেই আর্থিক সংকট শব্দবন্ধটি দেউলিয়াত্বের আশঙ্কায় ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের একযোগে অর্থ উত্তোলন (ব্যাংকিং পরিভাষায় যাকে বলা হয় ব্যাংক রান) সম্পদমূল্যের আকস্মিক পতনের মতো নাটকীয় ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত। চার্লস কিংডেলবার্জারের ধ্রুপদী বই দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ডিপ্রেশন ১৯২৯-১৯৩৯ ম্যানিয়াস, প্যানিকস অ্যান্ড ক্র্যাশেস এবং কেনেথ রগফের সঙ্গে লেখা দিস টাইম ইজ ডিফারেন্ট নামের আমার বইয়ে ধরনের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবশ্য ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের চিহ্ন হিসেবে লেম্যান মুহূর্তের মতো ঘটনাগুলো (সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকটের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে, যখন লেম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়েছিল) বেশি মাত্রায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কিছু আর্থিক সংকট থাকে, যেগুলোয় লেম্যান মুহূর্তের মতো নাটকীয়তা দেখা যায় না। ধরনের সংকটে অর্থনৈতিক অধোগতি যেহেতু অব্যাহত থাকে, সেজন্য ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ মানের তাত্পর্যজনকভাবে অবনমন ঘটতে পারে, বিশেষ করে যখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খানাগুলো ব্যাপকভাবে দেনাগ্রস্ত থাকে। আবার অনুৎপাদনশীল ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে (কিছু উন্নয়নশীল দেশ শেষোক্তটি খুব একটা অপরিচিত ঘটনা নয়) দীর্ঘ সময়ের ঋণদান ব্যাংকগুলোর স্থিতিপত্রে একটি ব্যাপকতর আবর্তনিক প্রভাব ফেলে।

যদিও এসব সংকটে সবসময় আতঙ্ক হুড়োহুড়ি করে আমানত উত্তোলনের মতো ঘটনা নাও দেখা যেতে পারে, তবু সেগুলোর ক্ষতি বহুমুখী সর্বব্যাপ্ত। এতে সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন পুঁজি পুনর্ভরণ সরকার করদাতাদের জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে, নতুন ঋণদান কমে যেতে পারে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হতে পারে। আকস্মিক ঋণ সংকটের বণ্টনগত প্রভাবও বিপুল। কারণ এটি ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে অধিক মাত্রায় আর্থিকভাবে পর্যুদস্ত করে।

সত্যি বলতে কি, ক্রমাগত সংক্রমণ হার বৃদ্ধি, দেশে দেশে লকডাউন আরোপ, উৎপাদনে রেকর্ড পতন এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতি অবনমনসহ অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তার বিভিন্ন মুহূর্ত সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে কভিড-১৯ মহামারী। কিন্তু এসব প্রবণতা ছাড়াও আর্থিক খাতে ভেতরে ভেতরে একটি নীরব ধীর সংকট পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কোনো লেম্যান মুহূর্ত দৃশ্যমান হওয়া ছাড়াই এটি এমনকি সামনের কয়েক বছরে সম্ভব হতে পারে এমন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ব্যাহত করতে পারে।

সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, কিছুদিনের জন্য বিশ্বজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণের (এনপিএল) লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটবে। কভিড-১৯ সংকটটি অনেক ক্ষেত্রে নিম্নগামীও। এটি নিম্ন আয়ের খানা-পরিবারগুলো এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসমানুপাতিক হারে পর্যুদস্ত করছে, দেউলিয়াত্ব বা আর্থিক অক্ষমতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাদের তুলনামূলক কম সম্পদ আছে।

মহামারীর শুরু থেকে গৃহীত ব্যাপকভিত্তিক লকডাউন সামাজিক দূরত্বসংক্রান্ত ব্যবস্থাসৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের লক্ষণীয় সংকোচনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারগুলো সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা আর্থিক নীতি গ্রহণের ওপর নির্ভর করেছে। এক্ষেত্রে সংকট মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো নিজেদের আর্থিক সক্ষমতার চূড়ান্ত সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছে বটে, তবে বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফে বিপুল পরিমাণ ঋণের জোগান জনস্বাস্থ্যস ম্পর্কিত জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় উদীয়মান বাজার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকেও অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য করেছে।

২০০৭-০৯ সংকটের (কিংবা বেশির ভাগ আগের সংকটগুলোয়ও) মতো ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের স্বল্পস্থায়ী ঋণ পরিশোধ স্থগিতাদেশসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রণোদনা নিয়ে সমর্থন জুগিয়েছে, যেমনটা আইএমএফ তার পলিসি ট্র্যাকারে নথিবদ্ধ করেছে। এসব পদক্ষেপ কাজ আয় হারানো পরিবারগুলো, লকডাউন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার (এক্ষেত্রে পর্যটন সম্পর্কিত খাতগুলোয় বেশি প্রভাব দেখা গেছে) কারণে টিকে থাকতে লড়াই করা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা ফুরসত দিয়েছে।

সব অঞ্চলের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান ঋণগুলোর পুনঃপরিশোধের জন্য গ্রেস পিরিয়ডের সুযোগ দিয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান আবার আরো সহজ শর্ত আরোপ সুদহার কমানোর মাধ্যমে ঋণ পুনঃসংকোচন করেছে। এখানে বোধগম্য যৌক্তিক মানদণ্ড বিবেচিত হয়েছে এই যে যেহেতু স্বাস্থ্য সংকট সাময়িক, সেহেতু প্রতিষ্ঠান পরিবারগুলোর আর্থিক সংকটও ক্ষণস্থায়ী হবে। তবে যেহেতু মহামারী এখনো চলছে, সেহেতু অনেক দেশে ২০২১ সাল নাগাদ উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

ঋণ পরিশোধ স্থগিতের সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি অনেক দেশ মন্দ ঋণের প্রভিশনিং এবং খেলাপি ঋণের শ্রেণীকরণ সম্পর্কিত বিধিমালা শিথিল করেছে। এসব পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখা যেতে পারে এবং অনেক দেশে লক্ষণীয়ভাবে তা- ঘটেছে। অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে নিজেদের স্থিতিপত্রে পড়া বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অপর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত হতে পারে। তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে দুর্বল ডিসক্লোজারের কারণে।

ব্যক্তি খাতে উল্লিখিত বিষয়গুলো উদ্ভূত হওয়া ছাড়াও ২০২০ সালে সার্বভৌম ঋণমানে রেকর্ড অবনমন ঘটেছে। উন্নত দেশগুলো বাদ না গেলেও উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশগুলোর ব্যাংকের পরিণাম বেশি ভয়াবহ, যেখানে সরকারগুলোর ঋণমান জাংক গ্রেডে বা তার কাছাকাছি রয়েছে। আরো ভয়াবহ পরিণামের বিষয় হলো সার্বভৌম ঋণের খেলাপি হওয়া এবং তা পুনর্গঠন করা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ধরনের সংকটগুলোও এখন বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলো সরকারি সিকিউরিটিজে তাদের শেয়ারধারণ হারাবে।

গত বছরের মার্চে আমি যেমনটা বলেছিলাম, এমনকি এক বা ততোধিক কার্যকর টিকা দ্রুত মহামারীর অবসান ঘটাতে সমর্থ হলেও কভিড-১৯ সংকট বৈশ্বিক অর্থনীতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিপত্রে তাত্পর্যজনকভাবে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। আর্থিক মুদ্রানীতির গতানুগতিক সুযোগের বাইরে ঋণ পরিশোধ স্থগিত করার নীতিগুলো মূল্যবান প্রণোদনা টুলসের জোগান দিয়েছে। তবে গ্রেস পিরিয়ডগুলো ২০২১ সালে শেষ হবে।

মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের চলতি বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে যেমনটা বলা হয়েছে, নীতিগত শৈথিল্য বা রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে আসন্ন আর্থিক মুদ্রাগত প্রণোদনা বছরের প্রথম দিকে উন্নীত হওয়া মাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে না। অনেক উদীয়মান বাজার উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে তাদের মুদ্রানীতির শেষ সীমা বা তার কাছাকাছি আছে। ২০২১ সালের আরো কিছুদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর এটি পরিষ্কার হবে যে আদৌ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান পরিবার আর্থিকভাবে দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি হচ্ছে কিনা।

মহামারীর প্রাক্কালে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চদেনা (মূলধনের চেয়ে দেনার পরিমাণ বেশি) আর্থিক খাতের স্থিতিপত্রের সমস্যা সম্প্রসারণ করবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র চীনের করপোরেশনগুলো ব্যাপকভাবে দেনাগ্রস্ত। ফলে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউরো অঞ্চলে বেড়ে চলা খেলাপি ঋণের ব্যাপারে বারবার উদ্বেগ জানিয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ অনেক উদীয়মান বাজারে ডলার স্বীকৃত করপোরেট ঋণের লক্ষণীয় বৃদ্ধি সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছে। আবার বাণিজ্যিক আবাসন খাত হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির এক্সপোজারও বিশ্বের অনেক অংশের জন্য আরেক উদ্বেগের উৎস।

স্থিতিপত্রের বিপর্যয় পুষিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগবে। আগের অতিমাত্রায় ঋণগ্রহণ প্রায় ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন ঋণ হ্রাসের (ডিলেভারেজ) পরিস্থিতিতে পর্যবসিত হয়েছিল, যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণদানের ব্যাপারে আরো সতর্ক হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে ধীর পুনরুদ্ধারের পর্যায়ক্রমিক ধাপ কয়েক বছরব্যাপী হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এসব আর্থিক সংকট সার্বভৌম ঋণ সংকটে পর্যবসিত হতে পারে, যেহেতু বেইলআউটগুলো ব্যক্তি খাতের সংকটপূর্ব ঋণ রাষ্ট্রীয় খাতের দায়ে রূপান্তরিত হয়।

আর্থিক নাজুকতা মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যার পরিধি মাত্রা চিহ্নিত করা, এরপর তাত্ক্ষণিকভাবে পুনর্গঠন করা এবং মন্দ ঋণ অবলোপন করা। এর বিকল্প অর্থাৎ জম্বি ঋণে সম্পদ প্রবাহিত করা প্রলম্বিত পুনরুদ্ধারের রেসিপি। মহামারী যেহেতু এরই মধ্যে বিপুল অর্থনৈতিক মানবিক ক্ষতি করেছে, কাজেই সেই দৃশ্যপট এড়ানো সব দেশের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সর্বোচ্চ প্রাধিকার হতে হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কারমেন এম রেইনহার্ট: বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন