বিশ্বজুড়ে এমন একটি বৈশ্বিক সংকট দেখা দিয়েছে, যা বিগত কয়েক প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায়নি। কভিড-১৯ একটি সর্বব্যাপী ও নজিরবিহীন মহামারী, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্তুতি ও বহুপক্ষীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। যদিও করোনাভাইরাস প্রাথমিকভাবে একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, কিন্তু এটি বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেছে।
মহামারীটির প্রাদুর্ভাবের জটিলতার কারণে সর্বস্তরের নীতিনির্ধারকরা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। সরকারগুলোকে জীবন ও জীবিকা রক্ষা, আর্থিক খাতের গতিশীলতা বজায় রাখা এবং অতিরিক্ত ঋণের বোঝা এড়ানোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছিল। এ অস্বাভাবিক সময়ে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গতি, যথার্থতা ও কার্যকারিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা পরিষ্কারভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যদিও বেশির ভাগ জাতীয় সরকার সংকট মোকাবেলায় সামগ্রিকভাবে একই পদ্ধতিতে সাড়া দিয়েছে, কিন্তু নীতিমালার কার্যকারিতা সারা দেশে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্তুতি ও সামাজিক সুরক্ষাবলয় সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থাগুলো সঠিক সামষ্টিক অর্থনীতি ও বিদ্যমান রাজস্ব সংস্থানের পাশাপাশি দেশগুলোকে এ ধরনের ধাক্কার জন্য দ্রুত ও আরো কার্যকরভাবে সাড়া দিতে সহায়তা করবে।
এ ধরনের ধাক্কা আরো ভয়াবহ ও খারাপ এবং সময়ের পরিক্রমায় আবার ফিরে আসার মতো হতে পারে। মহাবিপর্যয় শুরু হওয়ার পর এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতি সাধারণ আশাবাদ থেকে সবচেয়ে খারাপ মন্দায় নিমজ্জিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে যে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ চূড়ান্ত দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হবে, যা পৃথিবীকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কভিড-১৯-এর বোঝা এবং পরবর্তী লকডাউনের চাপ শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যাদের সামাজিক সুরক্ষাবলয়ে পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার নেই। ব্যাপক সহায়তা ছাড়া নিম্নবিত্ত ও অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীগুলো সহজেই গভীরতর দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। কিন্তু সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যকারিতা ও তার গতি, তথ্যের লভ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। যে দেশগুলোর কাছে সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের সম্পর্কে বিশদ, সহজেই ব্যবহারযোগ্য তথ্য রয়েছে তারা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তাদের কার্যক্রমগুলো খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে। যাদের কাছে এ ধরনের একীভূত তথ্য নেই, মহামারীর মধ্যে তথ্য জড়ো করা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
বেশির ভাগ দেশের মতো ইন্দোনেশিয়া জনস্বাস্থ্যের অবকাঠামোকে আরো শক্তিশালী করে, সামাজিক সুরক্ষা প্রসারিত করে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় সমর্থন বাড়িয়ে মহামারী মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিয়েছে। এরই মধ্যে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশকে একীভূত তথ্যের মাধ্যমে এ নীতির আওতায় আনা হয়েছে। বাকি ৬০ শতাংশ পরিবারকেও দ্রুত এ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
যেহেতু ক্ষুদ্র ব্যবসা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলো পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে তুলনামূলকভাবে সুগঠিত ছিল, তাই এ ক্ষেত্রগুলো মহামারী ও লকডাউনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো ইন্দোনেশিয়াও সুদহারে ভর্তুকি, ঋণ পুনর্গঠন, ক্রেডিট গ্যারান্টিসহ মূলধন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ছোট ব্যবসাকে সহায়তা করার নীতির ওপর জোর দিয়েছে।
২০২১ সাল বিবেচনায় এটি এরই মধ্যে পরিষ্কার যে বৈশ্বিক পুনর্গঠনের প্রকৃতি ও তার গতি কিছু আন্তঃসম্পর্কযুক্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বৈশ্বিক নেতৃত্ব। ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সাথে সংগতিপূর্ণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি সাধারণ প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো গভীর পতন থেকে বাঁচানোর জন্য জি-২০ নেতারা একত্রিত হয়ে কাজ করলেও আমরা এখন বিশ্বব্যাপী চরম নেতৃত্ব সংকটে রয়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাণিজ্য, ফাইভজি প্রযুক্তি ও অন্যান্য ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের কথা বলে আন্তর্জাতিক নানা সংকট ও তার সমাধানগুলোকে একপাশে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক নেতৃত্বের অভাবে প্রতিটি দেশ এসডিজির দিকে অগ্রগতি বজায় রেখে দীর্ঘস্থায়ী মহামারীর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে দেশীয়ভাবে কী করতে পারে সেদিকে মনোনিবেশ করতে একাকী কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও ছোট ব্যবসায় সহায়তা নীতিমালায় নারী সুবিধাভোগীদের জন্য বিশেষ প্রকল্প রয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মহিলাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করে না, অন্যান্য উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকেও গতিশীল করে। কারণ নারীরা শিশুদের জন্য আরো বেশি সংস্থান বরাদ্দ রাখে।
নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই লোকেরা কীভাবে কাজ করে এবং পারস্পরিক আচরণ করে তার ওপর মহামারীর প্রভাব এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। কভিডের কারণে সৃষ্ট এ বিচ্ছিন্নতা আরো দক্ষ, কার্যকর এবং আরামদায়ক কাজের ব্যবস্থা ও কার্বন হ্রাসের মাধ্যমে অর্থনীতিকে রূপান্তর করার একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ উভয়ই মূল্যবান ও শক্তিশালী অনুঘটক।
তদুপরি সর্বত্র সংকীর্ণ আর্থিক সংস্থান সত্ত্বেও জনসাধারণের ব্যয়ের মান বাড়ানোটা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বচ্ছ নীতিমালা, সঠিক তথ্য ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান সরকারি সম্পদ উন্নয়নের জন্য দরকারি জায়গায় ব্যয় হচ্ছে এটা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি।
কিন্তু যখন সরকার ঘরোয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মনোনিবেশ করছে, সে সময় টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনর্গঠনের জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সংকট তৈরি হবে। মহামারীটি আসন্ন ঋণের যে সুনামি সৃষ্টি করবে তার ব্যবস্থাপনার জন্য সমন্বিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেক দেশ সংকট তৈরি হওয়ার আগে থেকেই অস্থিতিশীল ঋণের বোঝা নিয়ে লড়াই করে আসছে এবং এটি বৈশ্বিক সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে আমানত হ্রাস ও সামনের সার্বভৌম ঋণের সংকট এড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাবে।
যেহেতু সব দেশে ভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত মহামারীটি পরাজিত হবে না, তাই সবার জন্য টিকার নিশ্চয়তার জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। সর্বজনীন টিকা ছাড়া কভিড-১৯ ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানকে আরো বাড়িয়ে তুলবে এবং সারা দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তুলবে।
২০০৮ সালের সংকটের শিক্ষাগুলো মনে করে এখন পর্যন্ত বিশ্ব সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে আমরা এখনো মহামারী পরীক্ষাটি পাস করতে পারিনি। ২০২০ সালের সংকট আমাদের দেখিয়েছে যে এ শতাব্দীর সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে আমাদের আরো বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
এখন বৈশ্বিক পুনর্গঠনের কাজ চলমান রয়েছে। আমাদের অবশ্যই বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার সংস্কার ও তা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং যারা এতে বাধা দেবে তাদের প্রতিহত করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি এমন এক নৌকা যা ৮০০ কোটি মানুষের ভাগ্য বহন করছে। প্রতিটি ব্যবসায়, প্রতিটি জাতীয় সরকার ও প্রতিটি বহুপক্ষীয় ফোরামের স্বার্থে এর পুনর্গঠন দরকার।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
শ্রী মুলিয়ানি ইন্দ্রবতী: ইন্দোনেশিয়ার অর্থমন্ত্রী
ভাষান্তর: হাসান তানভীর
