ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের অভাবে বিপর্যস্ত গাড়ি প্রস্তুতকারকরা

বণিক বার্তা ডেস্ক

মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর বিপর্যয় মেনে নেয়ার জন্য এক রকম প্রস্তুত হয়েই ছিলেন গাড়ি প্রস্তুতকারকরা। যেখানে সরবরাহ শিকলে ব্যাঘাত ঘটা এবং বিক্রয় হ্রাস পাওয়া তাদের জন্য প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি যে এক বছর পর তাদের জন্য বড় ধরনের সমস্যার নাম হতে যাচ্ছে প্লেস্টেশন।

গত বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়িতে আটকে থাকার কারণে গেমিং সিস্টেম, ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিকসের জন্য অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের (যেমন সিলিকন, জার্মেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম সালফাইড) ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এরপর চাহিদা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী গাড়ি প্রস্তুতকারকরাও চিপের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে, যা কিনা গ্যাসোলিন কিংবা স্টিলের মতোই অপরিহার্য জিনিসে পরিণত হয়। 

কার্যত এটি কোনো গাড়ি প্রস্তুতকারককেই ছাড় দেয়নি। টয়োটা মোটরকে চীনে নিজেদের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ফিয়াট ক্রিসলার অটোমোবাইলস সাময়িকভাবে অন্টারিও এবং মেক্সিকোয় নিজেদের উৎপাদন স্থগিত করে। ভক্সওয়াগনও চীন, ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের কারখানায় উৎপাদনে সমস্যা হওয়ার ব্যাপারে সতর্কবার্তা দেয়। ফোর্ড মোটর গত সপ্তাহে বলেছে, কেন্টাকির এক কারখানায় তারা যন্ত্রাংশের স্বল্পতায় ভুগছে।

এর আগে যখন কভিড-১৯ আঘাত হানে তখন গাড়ি প্রস্তুতকারকরা বিক্রয় হ্রাসের আশঙ্কায় চিপের অর্ডার কমিয়ে দিতে শুরু করে। একই সময়ে অর্ধপরিবাহী পদার্থের প্রস্তুতকারকরা ল্যাপটপ, ওয়েবক্যাম, ট্যাবলেট এবং ফাইভজি স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আসার উচ্চ চাহিদা পূরণের জন্য নিজেদের উৎপাদন লাইনকে সেদিকে সরিয়ে নেন। এছাড়া একই সময়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইন মিটিং এবং বাসা থেকে কাজ করার জন্য নিযুক্ত কর্মীদের পরিচালনার জন্য নিজেদের ডিজিটাল অবকাঠামোকে উন্নত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলো ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করার কারণে অর্ধপরিবাহী পদার্থের চাহিদা আরো বেড়ে যায়।

এরপর ২০২০ সালের শেষ দিকে প্রত্যাশার তুলনায় দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে গাড়ি বিক্রি, যা নতুন করে ব্যস্ততার দিকে ঠেলে দেয় প্রস্তুতকারকদের। স্বাভাবিকভাবে সে সময় চিপেরও ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু উৎপাদন লাইন পরিবর্তন করার কারণে তৈরি হয় চিপ-স্বল্পতা। ধারণা করা হচ্ছে চিপ-স্বল্পতা ২০২১ সালেও অব্যাহত থাকবে। কারণ উৎপাদন কার্যক্রমকে নতুন করে সাজানোর জন্য অর্ধপরিবাহী প্রস্তুতকারকদের ছয় থেকে নয় মাস সময় লাগবে।

পরামর্শক সংস্থা অ্যালিক্সপার্টনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডান হিয়েরশ বলেন, গ্রাহক চাহিদার কারণে এই বিস্ফোরণ দেখা গেছে। দেখা যাচ্ছে গাড়ি চলাচল যখন বন্ধ হয়ে পড়েছে তখন সবাই এক্সবক্স, প্লেস্টেশন ল্যাপটপ কেনার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু এক পর্যায়ে প্রত্যাশার তুলনায় দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করল গাড়ির চাহিদা এবং তখনই সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। 

তবে আশা করা হচ্ছে এই স্বল্পতার কারণে গাড়ির দাম খুব একটা বাড়বে না, কিন্তু ক্রেতাদের হয়তো পছন্দের গাড়ি কেনার জন্য একটু বাড়তি সময় অপেক্ষা করতে হবে।

চিপ-স্বল্পতার প্রাসঙ্গিকতা অবশ্য গাড়ি এবং অর্ধপরিবাহী প্রস্তুতকারী শিল্প পুুনর্গঠন করার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার মাঝেই রয়েছে। পাশাপাশি মহামারীও স্বল্পমেয়াদি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

গত দশকে গাড়ি প্রস্তুতকারকরা ব্যাপকভাবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। এটি তাদের পণ্যের আবেদনও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে টাচস্ক্রিন, কম্পিউটারাইজড ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ, সেলুলার, ওয়াই-ফাই সংযোগ, সংঘর্ষ এড়ানোর প্রক্রিয়ার জন্য ক্যামেরা এবং অন্যান্য সেন্সরের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো গাড়িতে যুক্ত করা হয়েছে।

নতুন একটি গাড়িতে একশর বেশি অর্ধপরিবাহীর প্রয়োজন হয়। যেখানে কেবল একটি উপাদানের স্বল্পতা উৎপাদনকে বিলম্বিত করতে পারে কিংবা কার্যক্রম বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করতে পারে। 

পাশাপাশি ভূরাজনীতিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং করপোরেশনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। কোম্পানির গ্রাহকরা তখন বিকল্প অনুসন্ধান শুরু করে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। তবে সব মিলিয়ে চিপ সংকটের এই দৃষ্টান্তটি মহামারী কতটা অপ্রত্যাশিত উপায়ে আমাদের ওপর আঘাত করেছে তারই যেন যথার্থ উদাহরণ।

নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন