অবরোধে অপ্রতিরোধ্য কাতারের বার্তা

শাহাদাত স্বাধীন

নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে একটি বুমেরাং অবরোধের দায় মাথায় নিয়ে অবশেষে কাতারের আমিরকে লাল গালিচায় বরণ করেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। কাতারের আমির শেখ তামিমও জিসিসি’র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে সৌদি বাদশাহ’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধে চাক্ষুষ একটি স্বস্তি আনলেন। 

ইসলামি বিপ্লবের পর সৌদি বাদশাহ’র সম্পর্ক উন্নয়নে হাত প্রত্যাখান করেছিল ইসলামি রিপাবলিক ইরান। ইরান-ইরাক যুদ্ধ ও বিপ্লবী প্রতিবেশীর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচতে মূলত জিসিসি গঠন করেছিল উপসাগরীয় ৬ আরব দেশ। আঞ্চলিক সহযোগিতায় এই জোটটির সাফল্য এতই ইর্ষণীয় ছিল যে অনেকেই জিসিসিকে এশিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্বোধন করতেন।  জিসিসি প্রতিষ্ঠার পর সদস্যদের মধ্যে ছোটখাট বিরোধ যে হয়নি তা নয়। আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে ওমানের সুলতান কাবুসকে পদচ্যুত করার চেষ্টার অভিযোগ ছিল। তবে একটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি জোট করে অবরোধ আরোপ জিসিসির মূল চিন্তার সাথে ছিল সাংঘর্ষিক। 

সৌদি অক্ষ ভেবেছিল অবরোধের মুখে টিকতে না পেরে কাতারের আমির সৌদি বাদশাহ’র কাছে নতি স্বীকার করবেন। কিন্তু এই অবরোধ মধ্যপ্রাচ্যের বুকে একটি অপ্রতিরোধ্য কাতারকে পরিচয় করিয়ে দিল বিশ্বকে। কাতারের প্রতি অন্যতম শর্ত ছিল ইরান, তুরস্ক, মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাস ও তালেবানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু অবরোধ কাতারকে এসব সম্পর্কে আরও ঘনিষ্ট করেছে। কাতারের তুর্কি ঘাঁটিতে সৈন্য বাড়িয়েছে এরদোয়ান সরকার। কাতারের মধ্যস্থতা ছাড়া তালেবানের সাথে মার্কিন আলোচনা অকল্পনীয়। ভবিষ্যতে হামাসের সাথে সৌদি- মার্কিন-ইসরাইল অক্ষ কোন আলাপে আসতে চাইলে দরকার হবে কাতারের দূতিয়ালির। 

অযৌক্তিক এই অবরোধে ইউরোপীয় সমর্থনও কুড়াতে পারেনি সৌদি জোট। বরং জার্মানীতে কাতারের যাত্রা ভঙ্গ করতে গিয়ে নিজেদের নাক কেটে এসেছিল সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ এর আলোচিত আয়োজক হতে যাওয়া কাতারের ভেন্যু বাতিলের প্রচেষ্টাও ছিল সৌদি নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু কাতার আপন মহিমায় বিশ্বের কাছে নিজেদের নিরাপদ দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বরং বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা থেকে নিজ নাগরিকদের বঞ্চিত হওয়ার ভয় ও কাতারে আসতে যাওয়া ইউরোপীয় পর্যটকদের টানতে সৌদি জোট নিজেরাই কাতারকে বরণ করতে বাধ্য হলো। 

অবরোধে নমনীয় না হয়ে কাতার বরং ‘কুয়ালামপুর সামিট’র আয়োজক অংশীদার হয়ে সুন্নি বিশ্বে সৌদি নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। এই সময়ে সৌদি আরব চাপ দিয়ে লিবিয়া, ইয়েমেন ও মালদ্বীপ সরকারকে কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেছিল। সমসাময়িক সময়ে সৌদি আরব বাংলাদেশে লালমনিরহাটে এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দর নির্মাণসহ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে ৩০ বিলিয়ন বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল। এই ঘোষণা ছিল বিনিয়োগ কূটনীতিতে বাংলাদেশকে আরও ঘনিষ্ট করার প্রয়াস। একই সময়ে কাতারও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। সৌদি আরবে বাংলাদেশের ২২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছে। অন্যদিকে কাতারে রয়েছে তিনলাখ বাংলাদেশী প্রবাসী। ফলে বাংলাদেশকে ভারসাম্য কূটনীতির আশ্রয় নিতে হয়েছে। কাতার সৌদি আরব সম্পর্ক পুনঃউন্নয়ন করেছে। কিন্তু চাপে পড়ে সৌদিকে অন্ধ অনুসরণ করা দেশগুলো এখন কাতারকে কতটা কাছে পাবে!

বর্তমান সময়ে ভারসাম্য কূটনীতির কোন বিকল্প নেই। মার্কিন-চীন এত দ্বন্দ্বের মধ্যেও বানিজ্য সম্পর্ক বিদ্যামান। চীন তার বিআরই প্রকল্পের অংশ হিসাবে ইসরাইলের বিনিয়োগ করেছে ৮ বিলিয়নেরও বেশী। বাংলাদেশ তুরস্ক বানিজ্য সম্পর্কের চেয়ে দশগুণ বড় তুরস্ক-ইসরাইল বানিজ্য সম্পর্ক। বর্তমান বিশ্বে স্থায়ী শত্রুতা ও স্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। তুরস্কে বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,  বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর থেকে তুর্কি জনগণের সাথে এই অঞ্চলের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। পরদিন বাংলাদেশ থেকে সৌদি ফ্লাইট বন্ধ, সৌদি অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভিসা প্রদানে বাংলাদেশকে চাপ দেয় রিয়াদ। সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে নিজেদের আপত্তি জানাতে এই চাপ। বাংলাদেশ চাপ সামাল দিয়ে নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ভারসাম্য কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে হবে। রিয়াদের চাপে আঙ্কারার কাছ থেকে সরে আসলে যেদিন আঙ্কারা-রিয়াদ বিরোধ মিটবে সেদিন ঢাকার কিছুই করার থাকবে না। 

বিপদ ও কঠিন সময় ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে বন্ধু চেনায়। বিপদে যে পাশে থাকে সেই তো বন্ধু। দোহা তার বিপদে যাদের পাশে পেয়েছে সামনের দিনে তাদের অগ্রাধীকার দিয়েই পররাষ্ট্রনীতি সাজাবে সন্দেহ নেই। অপরদিকে প্রতিবেশীদের একজোট হয়ে জল-স্থল-আকাশ পথ অবরোধের বেদনা সহজেই ভুলে যাবে না কাতার। জিসিসিভুক্ত দেশসমূহের আস্থা বিশ্বাসে যে ঘাটতি তৈরী হয়েছে তাও সহসাই কেটে যাবে না। গত সাড়ে তিনবছরের অযৌক্তিক অবরোধ কাতারকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে আরও স্বাবলম্বী ও শক্তিশালী করেছে। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের পর ২০৩২ অলিম্পিকের আয়োজক হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রতিরোধ্য শক্তি কাতার। ইতিমধ্যে কাতার বিরোধী রাষ্ট্রসমূহ মেনে নিয়েছে কাতারকে আমলে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ছক সাজাতে হবে। তবে সৌদি আরবের  ভূরাজনৈতিক অবস্থান, ধর্মীয় গুরত্বের কারণে সৌদির সুসম্পর্ক বিশ্বমঞ্চে কাতারের অবস্থান তৈরীতে সৃষ্ট অস্বস্তি দূর করবে। ইতিমধ্যে ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে সৌদি-আমিরাত মতভেদ তৈরী হয়েছে। কাতার সৌদিকে এটা বুঝাতে চাইবে বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদির পথচলায় আমিরাতের চেয়ে কাতারের বন্ধুত্ব সৌদিকে বেশী সফলতা এনে দিবে। সৌদি যুবরাজ যে মধ্যপ্রাচ্য যে নতুন ইউরোপ করতে যাচ্ছেন সেখানেও কাতার বড় ধরনের ছড়ি ঘুরানোর পরিকল্পনা করছে। অদূর ভবিষ্যতে দুবাই বা আবুধাবির চেয়ে দোহা আরও বেশী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে। এই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া মধ্যপ্রাচ্যে আমিরাত ও কাতারের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরী করবে। এই প্রতিযোগিতায় উভয় দেশই সৌদিকে নিজের আয়ত্বে রাখতে চাইবে।  সৌদি কী কাতার আর আমিরাতকে চালাবে নাকি এই দুইদেশের চাপে থাকতে হবে সৌদিকে নির্ভর করছে সৌদি নেতাদের বিচক্ষণতার উপর।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন