দেশের পোশাক ও পাদুকা শিল্পে ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলো থেকে স্থানান্তরের ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে পোশাক ও পাদুকা শিল্পের আকার বেড়েছে বাংলাদেশে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ঘরে থেকে কাজ করার মতো উৎপাদন পদ্ধতির ব্যবহারও।
‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম: ফ্রম ইনভিজিবিলিটি টু ডিসেন্ট ওয়ার্ক’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন গতকালই প্রকাশ করেছে আইএলও। এতে বলা হয়েছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার ধারাবাহিকতায় যেসব দেশে পোশাক ও পাদুকা শিল্পের আকার বেড়েছে, সেসব দেশে ঘরে বসে কাজের প্রবণতাও বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়াও যেসব দেশে ঘরে বসে কাজের প্রবণতা বেড়েছে; সেগুলোর মধ্যে কম্বোডিয়া, ভারত, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনের ঘরে বসে কাজ বা হোম ওয়ার্কিংয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পণ্যের চাহিদার ওঠানামা ও ব্যয় সংকোচনের মতো বিষয়গুলো সমন্বয় করে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে এক্ষেত্রে হোম ওয়ার্কারদেরই (যারা ঘরে বসে কাজ করছেন) ওপরেই প্রভাব পড়ে বেশি। নিয়োগকর্তাদের ব্যয় সংকোচনের জন্য উৎপাদন স্থগিত করে দেয়ার মতো সিদ্ধান্তের প্রভাব সরাসরি তাদের ওপরেই এসে পড়ে।
এতে আরো বলা হয়, কভিড-১৯-এর লকডাউন বা অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সাময়িকভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এ কারণে বাংলাদেশেরও অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে হোম ওয়ার্কারদের কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি অনেক হোম ওয়ার্কার কাজ করেও মজুরি পাননি।
প্রতিবেদনে পোশাক শিল্পে হোম ওয়ার্ক প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ইতালির মতো দেশগুলোয় এখনো উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে ঠিকই। যদিও বৈশ্বিক পোশাক উৎপাদন কার্যক্রমের প্রধান অংশটিই উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার অংশবিশেষ, পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়া বৈশ্বিক উৎপাদন অঞ্চল হয়ে উঠেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান।
আইএলওর অভিমত, বাংলাদেশী পরিবারগুলোয় এখন সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। এ কারণে নারীদের মধ্যেও বের হওয়ার বদলে বাড়িতে থেকেই কাজ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। দেশের পরিবারগুলো যত ধনী হচ্ছে, ততই পর্দাপ্রথার মতো পুরনো ঐতিহ্যগত রীতিগুলো সমাজে ফিরে আসছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্প খাতে ঘরে থেকে কাজ করার বিষয়টি বেশির ভাগ সময়ই পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে ঘরে থেকে কাজ করাসংক্রান্ত তাত্ত্বিক বিষয়গুলোও পোশাক শিল্পকে ঘিরেই দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের আকার ছিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে বৈশ্বিক রফতানি বাজারের আকার ছিল দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম এ খাতে বিশ্বের শীর্ষ রফতানিকারক দেশ। এসব দেশে পোশাক খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে মোট দেড় কোটি মানুষের। পোশাক শিল্পে শ্রমঘন উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকেই ঘরে থেকে কাজের গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। এর ফলে উৎপাদনে অটোমেশনের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়েছে।
হোম ওয়ার্কারদের জন্য ভালো সুরক্ষা প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আইএলও বলেছে, কভিড-১৯-এর প্রভাবে বাড়ি থেকে কাজ করার প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এতে করে হোম ওয়ার্কারদের কর্মক্ষেত্রের দুর্বল অভিজ্ঞতাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী নানা সংকটের মধ্যে থেকে এভাবে ঘরে বসে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা ২৬ কোটি।
মূলত বেসরকারি পর্যায়েই ঘরে থেকে কাজ করার প্রবণতাটি বেশি। এ কারণে হোম ওয়ার্কিং অদৃশ্য শ্রম খাত হিসেবে আখ্যায়িত দিয়েছে আইএলও। সংস্থাটি জানিয়েছে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় হোম ওয়ার্কারদের ৯০ শতাংশেরই কর্মসংস্থান মূলত অনানুষ্ঠানিক।
এসব শ্রমিককে ঘরের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে বাড়ির বাইরের চেয়েও বেশি খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় জানিয়ে আইএলও বলছে, যুক্তরাজ্যে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন হোম ওয়ার্কিং পেশাজীবীদের আয় বাড়ির বাইরে কাজ করাদের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ২২ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৫ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনা, ভারত ও মেক্সিকোয় ৫০ শতাংশ।
এছাড়া হোম ওয়ার্কারদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেশি মোকাবেলা করতে হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, এ ধরনের কর্মীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ অনেক কম। এছাড়া হোম ওয়ার্কারদের সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতির পাশাপাশি সংগঠিত হওয়া এবং দরকষাকষির শক্তিও অনেক বেশি সীমিত।
আইএলওর হিসাব বলছে, বৈশ্বিক মোট কর্মসংস্থানে হোম ওয়ার্কারদের অংশ রয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এ হোম ওয়ার্কারদের মধ্যে অধিকাংশই (৫৬ শতাংশ) নারী, যারা সংখ্যায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ। ২০২০ সালে কভিডের সংক্রমণ শুরুর কালে প্রতি পাঁচজন শ্রমিকের একজন বাড়ি থেকে কাজ করেছেন।
প্রচলিত কর্মক্ষেত্রের বাইরের এ শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশকিছু সুপারিশও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্প খাতের হোম ওয়ার্কারদের জন্য আইনি সুরক্ষার পরিধি বৃদ্ধি, কমপ্লায়েন্স উন্নত করা, লিখিত চুক্তি, সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করা এবং হোম ওয়ার্কারদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। এ বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে সরকার, শ্রমিক, নিয়োগকর্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে তাগিদ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশী শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা খাতে পিছিয়ে থাকার বিষয়টি এর আগেও নানা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইএলও। গত অক্টোবরে ‘দ্য প্রটেকশন উই ওয়ান্ট: সোস্যাল আউটলুক ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বিবেচনায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করা দেশগুলোর মধ্যে আছে মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভুটান। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসক্যাপ) সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আইএলও।
