পরিবর্তন

কুইন’স গ্যাম্বিটের ক্ষিপ্রতা ও ধীরগতি

কেনেথ রগোফ

২০২০ সালে নেটফ্লিক্সের অন্যতম সফল জনপ্রিয় মিনি সিরিজ দ্য কুইন গ্যাম্বিট- দাবার বিস্ময় বেথ হারমোন ( চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনিয়া টেইলর-জয়) ক্ষিপ্রগতি কৌশলের সাহায্যে একের পর এক তার পুরুষ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। কুইন গ্যাম্বিটবাংলায় এর অর্থ হয় রানীর প্যাঁচ বা চাল। গল্পের পটভূমি ১৯৫০ ৬০-এর দশকের। সেলফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়নি। কম্পিউটারে দাবার প্রোগ্রাম খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোরও সুযোগ নেই। সে সময়ের জীবন ছিল ধীর, ধাতস্থ তাড়াহীন। বর্তমানে মহামারীর কারণে আমরা যেমন করে সময় কাটাচ্ছি, অনেকটা তেমন।

ওই সময় অর্থাৎ ষাটের দশকে কেউ যদি দাবা খেলার কৌশল কিংবা জ্ঞান রপ্ত করতে উৎসাহী হতেন, তবে তাকে পড়তে হতো মডার্ন চেস ওপেনিংসের মতো বড় মোটাসোটা একটি বই। আর অপেক্ষা করে থাকতে হতো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দাবাবিষয়ক সিক্সটিফোর ম্যাগাজিনটি কবে নাগাদ এসে পৌঁছবে তার ওপর। সে সময়ে দাবার সেরা সব খেলোয়াড় ছিলেন সোভিয়েতে। মস্কো থেকে জাহাজে করে ম্যাগাজিনগুলো আমেরিকায় নিয়ে আসা হতো, যা ছিল দীর্ঘকালীন অপেক্ষার মতো। তবে খেলার নতুন কৌশল খবর জানার জন্য মন্থর গতিতে ভেসে আসা ওইসব জাহাজের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তেমন কোনো উপায়ও ছিল না তখন।

ওয়াল্টার টিভিসের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত দ্য কুইন গ্যাম্বিট ওয়েবসিরিজটি ক্ষুদ্র যে ধারণাটিকে উসকে দেয়, তা হচ্ছে আমেরিকার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু ববি ফিশার যদি একজন নারী হতেন, তাহলে কী হতো? ওয়াল্টার টিভিসের লেখা অন্য গল্পের মধ্যে দ্য হাসলার, দ্য কালার অব মানি কিংবা দ্য ম্যান হু ফেল টু আর্থ উল্লেখ্য। নিজের কল্পনাকে আকার দিয়ে দারুণ সব চরিত্র রচনার অনন্য ক্ষমতা নিয়ে টিভিস সবসময় গর্ব করতেন। তবে তিনি ভাগ্যবান যে তার লেখা কুইন গ্যাম্বিট বইটি বাস্তবের তিন দুর্দান্ত দাবাড়ু জুডিথ, জুসুসা জেসফিয়া পোলগারের আবির্ভাবের আগেই প্রকাশিত হয়ে গেছে। হাঙ্গেরির তিন সহোদরার বাস্তব জীবনের গল্প নিয়ে যদিও অসাধারণ একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব।

নেটফ্লিক্সের বেশির ভাগ সিরিজ নির্মাণের ক্ষেত্রেই প্রকৃত উপন্যাসের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয় পর্যবেক্ষণ এবং সময় বিষয়বস্তুর ওপর লক্ষ রাখার বিষয়টি উল্লেখ্য। যেমন কুইন গ্যাম্বিট তৈরি করতে গিয়ে নির্মাতা স্টক ফ্রাংক অন্তর্ভুক্ত করেছেন একসময়ের দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভ এবং কিংদবন্তি দাবা প্রশিক্ষক ব্রুস প্যান্ডলফিনির মতো ব্যক্তিত্বকে। কারণ পর্দায় ধারণকৃত দাবার প্রতিটি চাল সঠিক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

উপন্যাস অনুসারে নিজের রানী বিসর্জন দেয়ার মাধ্যমে বেথ তার প্রতিপক্ষকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। রানী বিসর্জনদাবা খেলার এক দুর্লভ উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। কুইন গ্যাম্বিট সিরিজটি বাস্তবে সংঘটিত তেমন একটি মুহূর্তকেও চিত্রিত করে। শুধু ব্যতিক্রমী এক সমাপ্তির নির্ভুলতা নির্ণয়ের জন্য কম্পিউটারের মাধ্যমে যাচাইকৃত দৃশ্যটি ব্যতীত সিরিজটির সপ্তম শেষ পর্বে দেখানো দৃশ্যগুলো সত্যিকার খেলার ওপর ভিত্তি করেই ধারণকৃত।

যদিও পর্দার কুইন গ্যাম্বিট দেখে কয়েকজন অনুযোগ করে বলেছেন, বেথ হারমোন চরিত্রে টেইলর-জয়ের মতো সুন্দরী অভিনেত্রীকে কিছুটা অবাস্তব ঠেকেছে। তাছাড়া বাস্তবে দাবা খেলোয়াড়দের তার মতো অতটা চমত্কার সাজ-পোশাকেও দেখা যায় না। অথচ তরুণ দাবা চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ববি ফিশার কিন্তু দেখতে বেশ আকর্ষণীয়ই ছিলেন। তাকে নিয়ে ১৯৭১ সালে লাইফ ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদও করে। পরিপাটি স্যুটে ফিশারের চেহারায় যে গর্বিত দীপ্তি ফুটে উঠত, সেখানে ছিল সাফল্য পেশাদারিত্বের চমত্কার এক সমন্বয়।

কুইন গ্যাম্বিট সিরিজটি পর্দার শৈল্পিক নির্মাণ গতির ওপর নির্ভর করেই এগিয়েছে। বাস্তবে দাবা কিন্তু দ্রুতগতির কোনো খেলা নয়। যদিও গতির সঙ্গে চাল দেয়ার দৃশ্যগুলো পর্দায় দেখতে আকর্ষণীয়, কার্যকরী। তবে চালসংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো দেখাটা আরো বেশি উপভোগ্য। তবে পর্দায় বিষয়টি সম্ভব হয়েছে কারণ টেইলর-জয় অনন্য কর্তৃত্ব অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দাবার চালের বিষয়গুলোকে আত্মস্থ করেছেন, যেন তিনি একজন পুরোদস্তুর পেশাদার দাবা খেলোয়াড়। পক্ষান্তরে বাস্তবের দাবার আসরগুলো যারপরনাই ধীরগতির। ১৯৭২ সালের আলোচিত দাবা প্রতিযোগিতার আসরে ববি ফিশার সোভিয়েত ইউনিয়নের বরিস স্প্যাস্কি তাদের খেলার সময় একেকটি চালের জন্য মিনিট করে সময় বরাদ্দ করেছিলেন। এতে প্রতিটি সেশন সম্পন্ন করতেই বেশ কয়েকটি ঘণ্টা ব্যয় হয়।

বর্তমানে সময় বণ্টনের এমন সতর্ক ধীর পদ্ধতি অনেকের কাছেই শাস্তিস্বরূপ। খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করার জন্য হাতের কাছেই যখন কম্পিউটার রয়েছে তখন আমরা কেন অযথা মাথা ঘামাব? তাছাড়া কঠিন কঠিন চাল যখন কম্পিউটারেই খুঁজে পাওয়া যায় তখন তা মনে রাখারও তো প্রয়োজন নেই। দ্রুতগতির কম্পিউটার বিশাল ডাটাবেজের সমাহার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পেশাদার দাবা আসরগুলোর ওপর গভীর প্রভাব ফেললেও খেলাটি এখনো যথেষ্ট সৃজনশীল আর্থিকভাবে স্বাস্থ্যবান।

যার আংশিক কারণ হচ্ছে, দাবা খুব দারুণভাবেই অনলাইন দুনিয়ার সঙ্গে মানিয়ে গেছে। নেটফ্লিক্সের সিরিজটির তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে দাবাবিষয়ক ওয়েবসাইট চেস ডটকমে প্রতিদিন নতুন করে এক লাখ ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছেন। দাবার বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন দাবাবিষয়ক একটি প্রযুক্তি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন প্লে ম্যাগনাস গ্রুপ নামে। সম্প্রতি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৯৩ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন তিনি। অর্থের পরিমাণটি ১৯৭২ সালে ববি ফিশার বরিস স্প্যাস্কির চ্যাম্পিয়ন আসরের লাখ ডলার মূল্যমানের চেয়ে ঢের বেশি। অনলাইনে দাবার আসরগুলো অনুসরণ করে এক কোটিরও বেশি মানুষ: দ্য কুইন গ্যাম্বিটে আমেরিকান দাবা প্রতিযোগিতার আসরটি যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে বিষয়টির তুলনা করে দেখুন তো (কুইনস গ্যাম্বিটে বেথের ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়ার দৃশ্যটি মূলত ১৯৭৫ সালে ওহিওতে অনুষ্ঠিত ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ আসর থেকে অনুপ্রাণিত। সে বছর অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে আমিও সে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গল্পের লেখক ওয়াল্টার টিভিস। মূলত আসরটি থেকে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তী সময়ে গল্পের কাহিনীতে তিনি কিছুটা পরিবর্তনও এনেছিলেন)

কম্পিউটার ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে খেলোয়াড়রা এর মাধ্যমে ধোঁকা দিতে সমর্থ হন। তবে দাবার আসরের আয়োজকরা যতদূর সম্ভব ধোঁকাবাজদের হঠকারিতাগুলো সামলাতে সক্ষম হয়েছেন। খেলোয়াড়দের ঘুঁটির চাল কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কিনা, তা কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তারা যাচাই করতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও এটি একটি চলমান চ্যালেঞ্জ। একটাই সমাধান আছে, যা ট্রেন্ডেও পরিণত হয়েছে; তা হচ্ছে খুব দ্রুততার সঙ্গে চাল দেয়া; একদম ক্ষিপ্রতার সঙ্গে।

প্রথম সিজনের জনপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে অনেকেই কুনই গ্যাম্বিটের দ্বিতীয় সিজনের কথা বলছেন। অভিনেত্রী টেইলর-জয়ও নিজেকে সেখানে সম্পৃক্ত করতে উৎসাহী। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দ্বিতীয় কোনো বই লিখে যাননি ওয়াল্টার টিভিস, যার ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি চিত্রনাট্য তৈরি করা যায়। টিভিসও তার গল্পের মূল চরিত্র বেথ হারমোনের মতো অতিরিক্ত মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে ১৯৮৪ সালে মৃত্যু হয় তার।

যাই হোক না কেন, দ্বিতীয় পর্বটি প্রথম সিজনের মতো জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনাও কম। বিশেষ সতর্কতা: ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দুই আমেরিকান দাবাড়ু ববি ফিশার এবং তারও এক শতাব্দী আগের পল মরফিতারা দুজনই নিজেদের বিশ্বের সেরা দাবা খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করার পরও কিন্তু এক ধরনের উত্কণ্ঠায় ভুগতেন। নিউ অরলিন্সের রাস্তায় মারফি যখন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন তখন বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গেই কথা বলতে দেখা যেত তাকে। এদিকে ফিশার মনুষ্য সঙ্গ পরিহার করে জীবনের শেষ দিনগুলোয় আইসল্যান্ডে গিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে শুরু করেন। আইসল্যান্ডই একমাত্র দেশ, যেখানে তিনি থাকার অনুমতি পান। তাই আমি বরং কুইন গ্যাম্বিটের প্রথম সিজনটিই আরো একবার দেখতে রাজি।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

কেনেথ রগোফ: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন