প্রকল্পে দলগত দুর্নীতি

বাছাই থেকে বাস্তবায়ন—সব স্তরে প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা দূর হোক

রাষ্ট্রীয় পরিসরে অন্যতম বড় দুশ্চিন্তার বিষয় বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি। নীতিনির্ধারণী মহলের নানা সময়ের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট। খোদ প্রধানমন্ত্রীও বেশ কয়েকবার প্রসঙ্গে কথা বলেছেন, ক্ষোভ জানিয়েছেন। পরিকল্পনামন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেও প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি দলগত দুর্নীতিও হয়। দুর্নীতির ফলে সরকারি বিনিয়োগের উদ্দেশ্য প্রত্যাশিত সুফল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।  

অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাব নেই। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি ঘোষণা করেছে। তা সত্ত্বেও প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। নিয়মিত বিরতিতেই ধরনের দুর্নীতির খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একটি প্রকল্পে বালিশ ফরিদপুরের একটি ভবনে জানালার পর্দা ক্রয়ে অনিয়ম যার বড় দৃষ্টান্ত। অনেক প্রকল্পেই হয়তো এমনটি হচ্ছে, প্রকাশ না হওয়ায় নাগরিকরা জানতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, প্রকল্পভিত্তিক দুর্নীতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ঘাটতি যেমন দায়ী, তেমনি বাছাই থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগত দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী। প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা কার্যকারিতার ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা করা হয় না। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রভাবশালীদের তদবিরে অনেক সময় প্রকল্প নেয়া হয়। ফলে শুরুতেই ধরনের প্রকল্প ন্যায্যতা সংকটে পড়ার পাশাপাশি দুর্নীতিরও সুযোগ থাকে এতে। একইভাবে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) লেখার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা বিরাজমান। এখতিয়ারগতভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাজ হলেও বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা এটি সম্পাদিত হয় এবং তাতে সহযোগিতা করেন সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এখানেও পছন্দের ঠিকাদারদের কথা বিবেচনায় রেখে প্রকল্প প্রস্তাবের বিন্যাস এবং অদৃশ্য লেনদেনের অভিযোগ বিস্তর। তদুপরি রয়েছে দরপত্র ঠিকাদার নিয়োগসংক্রান্ত ত্রুটি। ডিজিটালাইজেশনের ধারাবাহিকতায় সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর সংস্থায় বেশ আগেই -টেন্ডারিং প্রবর্তন করা হলেও উদ্দেশ্যের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে দরপত্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান ঘটেছে বটে কিন্তু আইনগত মারপ্যাঁচে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে সুনির্দিষ্ট বড় কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মূলত দুর্বল আইনের সুযোগে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মূল্যায়ন কমিটির কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে কমিশনের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেন। এতে বড় প্রতিষ্ঠানের একাধিপত্যে নতুন ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও গড়ে উঠতে পারছে না। এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বর্ণিত মানদণ্ডে উপকরণ ক্রয় করছে কিনা, বাস্তবায়ন কাজ যথাযথভাবে করছে কিনা, এসব বিষয় তদারকিতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এগুলো দূর করা সময়ের দাবি।

দুর্নীতির সমান্তরালে প্রকল্পে নিয়ম-নিষ্ঠা সুশৃঙ্খলার প্রমাণও একদম বিরল নয়। ২০১৯ সালে জাপানের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিনটি সেতু প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে বেশ কম ব্যয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করেছিল এবং অব্যয়িত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছিল। এটি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। সততা স্বচ্ছতার মডেলগুলো সামনে রেখে বিভিন্ন পর্যায়ে বিরাজমান ত্রুটি দূর করতে হবে। প্রকল্প নেয়ার আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রথমবারের মতো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন কাঠামো তৈরির খবর মিলছে। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ব্যয়-সুফল পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে আরো বেশি পরিপক্ব দূরদর্শী হওয়া চাই। দরপত্র প্রক্রিয়ায় একাধিপত্য অবসানে প্রয়োজনীয় আইনগত সংশোধনও দরকার। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক যেসব পরামর্শ দিয়েছে, সেগুলো আমলে নেয়া যেতে পারে। অনুরূপভাবে প্রধানমন্ত্রী দেশে নতুন ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো প্রকল্প শেষ না হলে অন্য কোনো প্রকল্প বড়দের না দেয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। উপকরণ ক্রয় থেকে শুরু করে তার যথাযথ ব্যবহার, প্রকল্প বাস্তবায়নসব ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি সক্ষমতার নিবিড় মেলবন্ধন ঘটানো চাই। এছাড়া নিয়মিতভাবে বাস্তবায়ন-পরবর্তী অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করাও আবশ্যক।

উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান করতে বিভিন্ন দেশে নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি প্রবর্তনের ফলে দুর্নীতি কমার প্রমাণ মিলেছে। আমাদের দেশেও সরকার প্রযুক্তি সন্নিবেশে মনোযোগ দিয়েছে। কাজটি আরো বেগবান করা প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগের অভিজ্ঞতা, বাস্তবায়ন নৈপুণ্য, দুর্বলতা, প্রাতিষ্ঠানিক একাগ্রতা পেশাদারিত্ব বিষয়ক তথ্যগুলো সংরক্ষণের জন্য এখনো কোনো ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি হয়নি। এটি করলে সঠিক ঠিকাদার চিহ্নিত করা যেমন সহজ হবে তেমনি কাজের নিম্নমান, বাস্তবায়নজনিত দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো এবং দুর্নীতি রোধ করাও অনেকাংশে সম্ভব হবে। প্রকল্পসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চাগুলো প্রবর্তনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, এটিই প্রতাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন