সাত-সতেরো

মার্কেটিংয়ের মজা!

মো. আব্দুল হামিদ

চার বছর সময় নিয়ে কোকা-কোলা এক গবেষণা পরিচালনা করে। প্রায় দুই লাখ ক্রেতা এক ব্লাইন্ড টেস্টে অংশ নেন, অর্থাৎ তাদের পানীয় অফার করা হয় কিন্তু গ্লাসে কোনো ব্র্যান্ড নেম বা লোগো কিংবা অন্য কোনো সংকেত থাকে না। সেগুলোর একটিতে ছিল কোকের ক্ল্যাসিক ভার্সন, অর্থাৎ যেটা শুরু থেকে চলছে। আরেকটা ছিল সামান্য পরিবর্তিত (নতুন) ফর্মুলা।

সেই গবেষণায় অংশ নেয়া সিংহভাগ মানুষ বলেছিল, নতুন ফর্মুলায় প্রস্তুতকৃত পানীয়টি বেটার। ফলে কর্তৃপক্ষ কোকের পুরনো ভার্সন বন্ধ করে নতুনটি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিজ্ঞাপনে সেটা ফোকাসও করে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ক্রেতারা নতুন কোকটি গ্রহণে অসম্মত হন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই (ক্রেতাদের চাপে) তারাক্ল্যাসিকভার্সনটি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়!

মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তী সময়ে তারা বাজারে দুই ধরনের কোকেরই সরবরাহ চালু রাখেএই আশায় যে ক্রেতারা নিশ্চয়ই একসময় নতুন ভার্সনটি গ্রহণ করবেন। কারণ নিরপেক্ষ গবেষণায় দেখা গেছে, সেটা বেশি সুস্বাদু। কিন্তু তাদের হতাশ করে দিয়ে পানীয় মার্কেটের সিংহভাগই (১৯.%) কোকা-কোলা ক্ল্যাসিক দখল করে থাকে।

অন্যদিকে নতুন ফর্মুলার কোকটি থাকে দশম স্থানে! জরিপ মতে, মাত্র দশমিক শতাংশ ক্রেতা নতুনটি ক্রয় করেছেন। দৃষ্টান্ত থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে ক্রেতারা মোটেই রেশনাল নন; বরং তারা বিশ্বাসী বা ক্ষেত্রবিশেষে অন্ধ অনুসারী! এটা সেই সব মার্কেটারের জন্য বড় শিক্ষা বহন করছে, যারা মনে করেন যে পণ্যের গুণগত মান ভালো হলে তারা জঙ্গলে বসে থাকলেও মানুষ তাদের খুঁজে বের করবে।

ইউনাইটেড এয়ারে ট্রাভেল করার সময় অসতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করায় বিখ্যাত এক সংগীত পরিচালক Dave Carroll-এর গিটারটি ভেঙে যায়। প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত না করায় বেশ কিছুদিন পর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন United Breaks Guitars গানটি।

খুব দ্রুতই তা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ইউটিউবে এখনো অনেক ভক্তকে মন্তব্য করতে দেখা যায় যে ওই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ তারা আর কখনো ইউনাইটেড এয়ারে ভ্রমণ করবে না! তাহলে ওই বিমান কর্তৃপক্ষ ঠিক কী পরিমাণ আর্থিক সামাজিক ক্ষতির শিকার হয়েছে বা হচ্ছে, তা কি অর্থমূল্যে পরিমাপ করা সম্ভব?

১৯৯২ সালে হুভার (ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্র্যান্ড) এবং ইয়োর লেইজার (ট্রাভেল এজেন্সি) যৌথভাবে এক প্রমোশনাল অফার দেয়। ঘোষণা ছিল যে ন্যূনতম ১০০ পাউন্ডের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কিনলে যুক্তরাষ্ট্রে দুটো টিকিট ফ্রি দেয়া হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে (?) সেই অফার এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে তারা চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি। অসংখ্য ক্রেতাকে সেই পণ্য কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়।

ফলে মানুষ বিরক্ত হয়ে উভয় কোম্পানির সমালোচনা করতে শুরু করে। কথায় বলে না, দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে, ঠিক তেমনটা। এতদিন যারা তাদের নামও জানত না, তারাও তাদেরপ্রতারণা বিষয়ে সোচ্চার হয়। এতদিনের ইমেজ নয়, বরং তারা যে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে, সেটাই ক্রেতাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে ওভার ওয়েটের কারণে। অথচ তারা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি লাগেজ বা প্যাসেঞ্জার নেয়নি! বিষয়টি নিয়ে তাদের ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি খুব চিন্তায় পড়ে যায়। এর রহস্য উদ্ঘাটনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় ১৯৯৫ সালের তুলনায় আমেরিকানরা বর্তমানে (গবেষণা চলাকালে) গড়ে ২০ পাউন্ড বেশি ভারী হয়েছে! অথচ তারা এতদিন বিমান যাত্রীদের গড় ওজন একই রকম বিবেচনা করে আসছিল।
পরে তারা যাত্রীপ্রতি ১০ পাউন্ড কম পণ্য নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যেন অতিরিক্ত ওজনের কারণে আর কোনো বিমান দুর্ঘটনায় না পড়ে।

যুক্তরাজ্যে ১২ সাইজের একটি ড্রেস এখন ২০ বছর আগের তুলনায় দেড় ইঞ্চি লম্বা। অথচ নব্বইয়ের দশকে বিমানের সিটের সাইজ যে ২৬ ইঞ্চি ছিল, এখনো সেটাই বহাল রয়েছে। মানুষ লম্বায় বাড়লে ওজনও বাড়ে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।

এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের সাইজ বাড়া সত্ত্বেও কিছু ট্রেন কোম্পানি তাদের সিট ইঞ্চি পর্যন্ত কমিয়ে ফেলেছে, স্মার্ট করার অজুহাতে সিটগুলো আরো কাছাকাছি এনেছে। ক্রেতাদের সত্যিকারের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে চাইলে এমন অসংখ্য (অদৃশ্য কিন্তু প্রভাব বিস্তারকারী) বিষয়ও নজরে আসা দরকার; যা হয়তো আপনার প্রতিযোগীরা এখনো কল্পনা করতেও পারছেন না।

এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৩০ সালের দিকে প্রত্যেক আমেরিকানের গড়ে নয় সেট করে পোশাক থাকত। প্রায় ১০০ বছর পর এখন তা রয়েছে ৩০ সেটের ওপরে! শুধু কি তাই, যুক্তরাজ্যে নারীদের গড়ে ৩২ সেট করে পোশাক ক্লোসেটে তোলা আছে, যেগুলো একবারও পরা হয়নি!

তার পরও তারা শপিং করার জন্য বিভিন্ন স্টোরে নিয়মিত ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকের কাছে নতুন পোশাক কেনাটা নেশার মতো হয়ে গেছে। সত্যিকারের প্রয়োজন আছে কিনা, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। এমনকি সেই পোশাকগুলো রাখার জন্য অনেকে আবার নতুন আলমারি বা ওয়্যারড্রোব কিনতে বাধ্য হচ্ছে!

কোনো একটি ঘটনার ক্ষেত্রে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণকে করেছে নাকি কী ঘটেছে? ইংরেজি ভাষায় কে করেছে তা খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় মনে রাখা হয় ঘটনাটি। যেমন আপনার বাসার একটি সুন্দর শোপিস পরিষ্কার করার সময় হয়তো এক কাজের মেয়ে কয়েক বছর আগে ভেঙে ফেলেছিল। পরে তা জোড়া লাগিয়ে আগের স্থানে
রাখা হয়েছে। এখনো কেউ সেই ভাঙা দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেই কাজের মেয়েটার নাম ধরে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন!

কিন্তু একজন স্প্যানিশ ওটাকে দেখে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে। ফলে সে হলে বলতশোপিসটি মোছার সময় হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। অর্থাৎ সেটা যে নিতান্তই দুর্ঘটনা, তা ভাবায় তাকে ওই কাজের মেয়েটার নাম বছরের পর বছর মাথায় করে বয়ে বেড়াতে হয় না। তাছাড়া রকম মনে রাখা আমাদের রাগ-ক্ষোভ বাড়ানো ছাড়া তেমন কোনো কল্যাণ করতে পারে কি? উত্তরাধিকারসূত্রেই সম্ভবত আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে বৈশিষ্ট্য পেয়েছি। তাই কোনো ঘটনায় সর্বপ্রথম জানতে চাইকে করেছে বা এর জন্য দায়ী কে?

এক গবেষণায় দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ ব্রিটিশ এবং ৮০ শতাংশ মার্কিন কোম্পানির লক্ষ্য থাকে স্বল্পমেয়াদে মুনাফা অর্জন করা। অন্যদিকে মাত্র ২৭ শতাংশ জাপানি কোম্পানি লক্ষ্যে কাজ করে! অর্থাৎ তাদের দৃষ্টি থাকে অনেক দূরে। গত শতাব্দীতে এই কনসেপ্ট বেশ সফলতা পেয়েছিল। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে প্রযুক্তির বিস্তার এতটাই বেড়েছে যে
অধিকাংশ পণ্যের জীবনচক্র খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। ফলে এখন শুধু দীর্ঘমেয়াদে তাকালে সফল হওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। বরং এখনকার কার্যকর কৌশলটা হলো ব্র্যান্ড ইমেজটা দীর্ঘস্থায়ী করা।

অস্থির এক সময়ে বাস করছি আমরা। সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গ্রহণ-বর্জনের গতি এতটাই বেশি যে সেটা ভালো নাকি মন্দ, তা যাচাইয়ের সময়টুকুও মিলছে না। রেডিও আবিষ্কারের পর বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটি শ্রোতার কাছে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৩৮ বছর। টেলিভিশনের একই পরিমাণ দর্শক-শ্রোতা পেতে সময় লেগেছে ১৩ বছর! ইন্টারনেটের লেগেছিল চার বছর!

তাহলে বলুন তোফেসবুক’-এর ওই পরিমাণ ব্যবহারকারী পেতে ঠিক কতটা সময় লেগেছিল? মাত্র দুই বছর! এমন (জুম, টিকটক, লাইকির মতো) নিত্যনতুন পণ্য যুক্ত হওয়া এবং পরিবর্তিত জীবনধারা আমাদের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? এক কথায় তার জবাব দেয়া মুশকিল। তবে
-সংক্রান্ত তথ্যগুলো আমাদের এই প্রেক্ষাপট বুঝতে
সাহায্য করবে।

শোনা যায়, এলভিস প্রিসলির পাবলিক রিলেশন অফিসার ছিলেন খুব কড়া। পাবলিক অ্যাপিয়েরেন্সের ক্ষেত্রে তিনি মিনিট-সেকেন্ড বেঁধে দিতেন। অর্থাৎ হোটেল কক্ষের লবি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কয় সেকেন্ডে তিনি পথটা অতিক্রম করবেন, কোন হাত নাড়াবেন, ছবি তোলার জন্য কতক্ষণ দাঁড়াবেন. কোন দিকে ঘুরে দাঁড়ালে লাইট ভালো পাওয়া যাবে...এমন অসংখ্য বিষয়ে আগেই ব্রিফ করা হতো।

প্রিসলিকে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হতো। কারণ নিয়োগ দেয়ার সময় তিনি নিজেই তাতে সম্মত হয়েছিলেন। তখন মনে করা হতো একজন সেলিব্রেটি সহজলভ্য হবেন না। তিনি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় পাবলিকের মধ্যে বা
সামনে থাকলে তার ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ কমে যাবে। মিডিয়া বা ভক্তরা আগের মতো উত্সুক হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার জন্য অপেক্ষা করবে না!

আমরা যখন নিজেকে ব্র্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠার কথা ভাবি তখন টার্গেট অডিয়েন্সকে অসংখ্য তথ্য দিতে মন চায়। আমার প্রথম বই (শিক্ষা স্বপ্ন ক্যারিয়ার)- লেখক পরিচিতিতে বড় এক রচনা লেখার পরেও মনে হচ্ছিল অনেক কথাই এখনো বলা হলো না। এটা শুধু যে আমরা করি তা নয়। ১৯৮৩ সালে স্টিভ জবস অ্যাপলের নতুন কম্পিউটার বাজারে ছাড়া উপলক্ষে নিউইয়র্ক টাইমসে নয় পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন!

সেখানে কম্পিউটারবিষয়ক সূক্ষ্ম সব বিষয়ের ব্যাখ্যা ছিল। যা কোনো সম্ভাব্য কম্পিউটার ক্রেতার পড়ার সময় ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। অথচ তিনি সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে পিক্সারে কাজ করার সময় বুঝলেন কমিউনিকেশন মানেইঅনেক কিছু বলানয়। বরং যা বললে, যতটুকু বললে তারা শুনবে শুধু সেটুকু বলা দরকার। ফলে তিনি অ্যাপলে ফিরে আসার পরে গোটা আমেরিকায় প্রচারে শুধু দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তাও সেগুলো সরাসরি কম্পিউটার বা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তিনি বড় বিলবোর্ডগুলোয় অ্যাপলের লোগোর পাশাপাশি শুধু লিখলেন: Think Different.

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক   মার্কেটিংয়ের সহজপাঠ বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন