লকডাউনে লণ্ডভণ্ড এক সুখী পরিবারের গল্প

বণিক বার্তা অনলাইন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে ২৪ মার্চ ভারতজুড়ে লকডাউন ঘোষণার কথা রাজন যাদব যখন শুনলেন, তখন তিনি ভাবতেও পারেননি এটি তার জীবন চিরতরে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চলেছে। যাদব ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের বাসিন্দা।  এক বুক স্বপ্ন প্রতিদিন হাজার মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসে এ শহরে।  যাদবের গল্পটিও তাদের থেকে আলাদা নয়। 

এক দশকেরও বেশি আগে যাদব স্ত্রী সঞ্জুকে নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দেন।  প্রথমে কারখানার কাজ করতেন।  সঞ্জু গৃহিণী, তাদের ১১ বছর বয়সী ছেলে নিতিন এবং ছয় বছর বয়সী মেয়ে নন্দিনীকে দেখভাল করতেন। ২০১৭ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কেনেন যাদব। এরপরই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে।  সন্তানদের ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন।  যেখানে অনেক ভারতীয় বাবা-মাই সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাটাকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করেন। 

কিন্তু দুই বছরের মাথায় এই অটোরিকশাই ঘটিয়ে দেয় ভয়ানক ট্র্যাজেডি।  তবে এই ট্র্যাজেডির পেছনে যাদব লকডাউনের সময়ে মে মাসে মুম্বাই ছাড়ার সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেন। কিন্তু শহর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া তার কাছে কোনো বিকল্পও ছিল না। 

লকডাউনে অটোরিকশা চালাতে না পেরে জমানো টাকা ভেঙে পরিবারের খরচ চালানো শুরু করেন। সেই অর্থে মার্চ ও এপ্রিল মাসে বাসা ভাড়া, ঋণ পরিশোধ ও মুদি খরচ মেটানো সম্ভব হয়। তারা আশা করেছিলেন, মে মাসে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছিল। 

এর মধ্যে জমানো টাকা ফুরিয়ে যায়।  উত্তর প্রদেশের জৌনপুর জেলায় নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।  গ্রামে ফেরা মানুষদের জন্য তখন চালু থাকা বিশেষ ট্রেনের টিকিটের জন্য নামও লিখিয়েছিলেন।  তবে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেই টিকিট পাননি।  অবশেষে ট্রেনের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের অটোরিকশাটিতে করে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

চারজনের এ পরিবার ৯ মে মুম্বাই ছাড়ে।  ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত একটানা অটোরিকশা চালান যাদব, এরপর সবাই মিলে বিশ্রাম নেন।  আবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা অবধি চলে যাত্রা।  নিঃসন্দেজে এটি ছিল এক কঠিন ভ্রমণ।  তবে গ্রামে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকার আশায় সেই কষ্ট ভুলে ছিলেন তারা।  এভাবে তিন দিন যাত্রার পর গন্তব্য থেকে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরে একটি ট্রাক পেছন থেকে তাদের অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থালেই প্রাণ হারান যাদবের স্ত্রী ও কন্যা।

যদিও এ দুর্ঘটনা তখন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। ভারতে লকডাউন চলাকালীন শহর ছাড়তে গিয়ে কয়েক ডজন মানুষ মারা যান। লকডাউনে তাদের আয় বন্ধ এবং সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরিবহনের অভাবে নারী, পুরুষ ও শিশুরা অটোরিকশা, লরি, পানির ট্যাঙ্কার, দুধের ট্রাক ও সাইকেলে করে গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সবশেষে যাদব ও তার ছেলে নিতিন গ্রামে পৌঁছে।  যাদব বলেন, নিতিন অনবরত তার মা ও বোন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু আমার কাছে কোনো উত্তর ছিল না। 

যাদব ফসলের মাঠেই দিন কাটাতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে ভাইদের সাহায্য করতেন। তবে বেশিরভাগ সময়ই আকাশের দিকে চেয়ে, গাছের নিচে উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকতেন। তিনি কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতেন না; এমনকি নিতিনের সঙ্গেও নয়। নিতিনকে তার দাদা-দাদি দেখাশোনা করতেন। 

এভাবেই তিন মাস কেটে যায়। হঠাৎ একদিন শিশু নিতিন যাদবকে প্রশ্ন করে বসে, ‘মা আমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল, তোমার কি মনে হয় এটি এখনো সম্ভব? তুমি কি আমাকে গ্রামে রেখে যাবে? 


এ প্রশ্ন যাদবের স্ত্রীর কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের সবকিছুর ঊর্ধে বাচ্চাদের পড়াশোনা প্রাধান্য পাবে। যাদব তখন বুঝতে পারেন তিনি নিতিনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন না।  তখন ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শুরু করেন। তবে মুম্বাইতে ফিরে আসার কথা তার তখনো মনে আসেনি। 

তিনি বলেন, এটা সম্ভব ছিল না। আমি সঞ্জুকে ছাড়া ওই শহরে ফিরতে পারি না। সে আমার সাফল্যের সমান অংশীদার ছিল। তার জন্যই মুম্বাইয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

এছাড়া তার পরিবারের প্রধান আয়ের উত্স অটোরিকশাটাও প্রায় দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। সেটি মেরামত করার টাকাও তার ছিল না। তিনি স্থানীয় রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু সবাই নিরাশ করেছে।  এরপর বাবা-মা তাকে সঞ্জুর গহনাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেন।  কিন্তু যাদব স্ত্রী গহনা বিক্রি করতে চাচ্ছিলেন না।  এই গহনাগুলো তাকে সঞ্জু ও তাদের আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।  তিনি বলেন, এটি ছিল আমার সুখস্মৃতির শেষ টুকরোটি বিক্রি করার মতো।  সঞ্জুর স্মৃতির শেষ অংশটুকুও আমাকে বিক্রি করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো উপায়ও ছিল না। 

অবশেষে গহনাগুলো বিক্রি করে অটোরিকশাটি মেরামত করা হয়।  এবার অটোরিকশাটি ট্রাকে করে মুম্বাই পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার টাকা ছিল না।  ফের ছেলেকে নিয়ে সেই অটোরিকশা চালিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন যাদব। 

নভেম্বরের প্রথম দিকে তারা মুম্বাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন। চারদিন পর বাবা-ছেলে মুম্বাইতে পৌঁছে। যাদব বলেন, আমি সেই দুর্ঘটনার রাস্তাটি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সঞ্জু ও নন্দিনী যেন বারবার আমার সামনে এসে হাজির হয়, তাদের  উপেক্ষা করতে পারি না। 

মুম্বাই ফিরে এক বন্ধুর ভাড়া বাড়ির একটি ঘরে তারা ওঠে।  করোনার প্রকোপ তখনো কমেনি।  রাস্তায় খুব বেশি যাত্রী নেই। ফলে দৈনিক উপার্জন সামান্যই। এছাড়া ছেলের অনলাইন ক্লাসেও তাকে সহায়তা করতে হয়। তিনি বলেন, সকালে উঠে রান্না করে সকাল ৯টায় নিতিনের অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে তার হোমওয়ার্ক প্রস্তুত করে দিতে হয়। এরপর অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে দুপুরের পর এসে আবার রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করি। এরপর বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার বেরিয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরি।

যাদব চান দ্রুত পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ শুরু হওয়ায় নতুন করে আশা দেখছেন যাদব। তবে সন্দেহও রয়েছে। তিনি বলেন, আমার মতো দরিদ্র লোকেরা কি টিকা পাবে? আমি আমার জীবনকে প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি। আমি কভিডে আক্রান্ত হলে ছেলের কী হবে- তা নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। লকডাউন ঘোষণার আগে তারা আমাদের নিয়ে চিন্তা করেনি। তারা যদি আমাদের কথা ভাবতো তাহলে আমার সঞ্জু আর নন্দিনীকে হারাতে হতো না।

বিবিসি অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন