ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ

এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কারখানা এখন নিবুনিবু করছে

বদরুল আলম

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম পথিকৃৎ উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান সিনহা। ১৯৮৪ সালে ওপেক্স গ্রুপের মাধ্যমে পোশাক কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের মাধ্যমে স্থাপন করেন পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও। ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কাঁচপুরে ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তার শিল্প উদ্যোগ বস্ত্র পোশাক খাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র।

বিশাল শিল্প গ্রুপের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা ক্রেতাদের নজর কেড়েছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। ওই সময় পোশাকের কার্যাদেশ দিতে দিনের পর দিন তার সাক্ষাৎ লাভের অপেক্ষায় থাকতেন ক্রেতারা। সাক্ষাতের জন্য সময় না পেলে অনেকে তার বিদেশযাত্রার সময়সূচি সংগ্রহ করতেন। লক্ষ্য থাকত, বিমানে একান্তে পেলে ক্রয়াদেশের বিষয়ে কথা বলা। কিন্তু সবই এখন রূপকথা। একসময় ওপেক্স-সিনহা গ্রুপের সাব-কন্ট্রাক্ট বা ঠিকার কাজ করে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হলেও এখন নিজেই ধুঁকছে পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান। পোশাক শিল্পের সেই বাতিঘর এখন প্রায় নিবুনিবু বলে জানিয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

খাতসংশ্লিষ্টদের বলা কথার সত্যতা পাওয়া গেছে সরকারি সংস্থার দেয়া তথ্যেও। শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কাঁচপুরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের ম্যানুফ্যাকচারিং কমপ্লেক্সে বর্তমানে কেবল নয়টি ইউনিট সচল আছে। একসময় ওই গ্রুপের কাঁচপুরের ইউনিটগুলোতে ৪৫ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করলেও বর্তমানে সংখ্যা ১৩ থেকে ১৪ হাজারে নেমে এসেছে। কেবল তা নয়, গত তিন বছরের নানা সময়ে শ্রম অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছে গ্রুপটিকে। ছাঁটাই হয়েছেন অনেক পুরনো কর্মী। নিয়মিত কর্মীদের বেতন বকেয়া পড়ার অভিযোগও উঠেছে একাধিকবার। অতিসম্প্রতি কারখানা লে-অফের ঘটনা ঘটেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত লে-অফ থাকা কারখানার লে-অফের মেয়াদ বেড়েছে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

জানতে চাইলে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান সিনহা বণিক বার্তাকে বলেন, বিনিয়োগটা অনেক বেশি করে ফেলেছিলাম। তাতে অবকাঠামোটা খুব শক্তপোক্ত হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার মতো আমাদেরও ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে।

অর্থকড়ি খরচ করা নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে ভালো পোশাক পরিধানের কালচার ছিল, সেই কালচার এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন প্রযুক্তি পণ্যে বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যে মানুষের ব্যয়ের অভ্যাস বেড়েছে। অর্থাৎ পোশাক কেনাকাটায় ব্যয় অনেক কমিয়েছে মানুষ। তার পরও আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারত, যদি কভিড এসে ধাক্কা না দিত। করোনা এসে অনেক কিছুকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এই সময়টায় আমাদের টিকে থাকতে হবে।

কারখানা লে-অফের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, সবটা না, অল্প কিছু লোক লে-অফের মধ্যে পড়েছে। দশটা লাইন থাকলে দুটি লাইনে যদি কাজ কম হয় তখনই লে-অফ করা হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কয়েক বছর ধরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের কারখানায় প্রায়ই সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মীরা চাপ দিতেন কর্তৃপক্ষকে। আইনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সুবিধা দিতে বাধ্য হতেন আনিসুর রহমান সিনহা। এতে তার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। এখন আর এত বড় উৎপাদন সক্ষমতা পূর্ণ সচল রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। আনিসুর রহমান সিনহার জন্য সাম্রাজ্য এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। বোঝা বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কাজের নেশায় তিনি একের পর এক সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেগুলোই তার হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোভাবেই বোঝামুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। আবার পিছুটানও কাজ করছে তার। কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করা একমাত্র সন্তানের কাছে চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন পিছিয়ে দিচ্ছেন বারবার।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যবসায়িক কার্যালয় খুলেছিলেন আনিসুর রহমান সিনহা। যুক্তরাজ্য, হংকং, চীন, জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রেও আছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইলের কার্যালয়। যুক্তরাজ্যে আছে ওপেক্স ফ্যাশন লিমিটেড নামের লিয়াজোঁ অফিস। ২০১০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বিশ্বের সব নামকরা বড় ক্রেতার কাজগুলোর সমন্বয় সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই অফিসটি চালু করেছিলেন তিনি। সেখানে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে রয়েছেন তার একমাত্র সন্তান তানজিয়া সিনহা। বাংলাদেশসহ চীন ভারতের ১৪০টিরও বেশি কারখানাকে ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার হয় বলে দাবি ওপেক্স ফ্যাশন ইউকের।

অনেক বড় উৎপাদন সক্ষমতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিক সংগঠনের এক নেতা। তিনি বলেন, কাঁচপুরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের ইউনিটগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে হলে মাসে ন্যূনতম থেকে দেড় কোটি পিস পোশাক তৈরির কাজ থাকতে হবে। তবে এই বড় বিনিয়োগ কোনো সমস্যা হতো না যদি কাজ থাকত।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপে অনেক সমস্যা আগে থেকেই চলে এলেও সেগুলো প্রকট হয় রানা প্লাজা ধস পরবর্তী প্রেক্ষাপটে। কারখানা মূল্যায়নে নিয়োজিত জোট অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স অযাচিতভাবে সিনহার কারখানা ইউনিটগুলোর ভবন ত্রুটি নিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে দেয়। আগে অনেক বড় ক্রেতা ওপেক্স অ্যান্ড সিনহায় কাজ দিত। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তাণ্ডবে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিলের পাশাপাশি অনেক পণ্য মজুদ পড়ে থাকে তার কারখানায়।

বর্তমানে আনিসুর রহমান সিনহার ব্যবসা আরো কঠিন করে তুলেছে ঋণের দায়। রানা প্লাজা ধসের আগে বড় আকারের ব্যাংকঋণ ছিল না। কিন্তু রানা প্লাজা ধস পরবর্তী সময়ে ব্যাংক দেনা বেড়েছে তার। এখনও রফতানি আদেশ নেয়ার সক্ষমতা থাকলেও ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থায় শ্রেণীকরণকৃত ঋণগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা অব্যাহত  রেখেছেন ব্যবসায়ী।

ব্যাংক দায়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনিসুর রহমান সিনহা বলেন, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় গত ২৯শে ডিসেম্বর কথা হয় ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা  টেক্সটাইল গ্রুপের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কাঁচপুরে গ্রুপের বেশির ভাগ কারখানাই এখন লে-অফ ঘোষিত অবস্থায় আছে। তবে মিরপুর আশুলিয়ায় কারখানা চালু আছে। বন্ধ থাকা কারখানা চালু করতে চাচ্ছে মালিকপক্ষ। কিন্তু আর্থিক সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরো বেশকিছু ব্যাংকের বিপুল অংকের দেনা রয়েছে গ্রুপের।

যোগাযোগ করা হলে এক ব্যাংকার জানিয়েছেন, ব্যাংক এশিয়ায় আনিসুর রহমান সিনহার পরিচালক-স্বত্ব ছিল তিনটি। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এর একটি বিক্রি করে দিয়েছেন ৬০ কোটি টাকায়। পোশাক খাতেরই আরেক বড় গ্রুপের কর্ণধার তা কিনে নিয়েছেন। ইস্টার্ন ব্যাংকেও ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা  টেক্সটাইল গ্রুপের দায় ছিল। এখন দিন দিন আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে ইবিএল কর্তৃপক্ষ অন্য ব্যাংকে দায় হস্তান্তর করেছে।

পোশাক খাতের শিল্প মালিক সংগঠনের এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, আনিসুর রহমান সিনহা তার হাতে গড়া গ্রুপটি বিক্রির উদ্যোগও একাধিকবার নিয়েছেন। ভারতের রিলায়েন্সসহ আরো কিছু কোম্পানি তা ক্রয়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও করেছে। কিন্তু দেনাসহ অনেক বড় হয়ে যায় বিনিয়োগের পরিমাণ। আর আনিসুর রহমান সাহেবও কম দামে ছাড়তে চাচ্ছেন না। কারণে এত বড় প্রকল্পের ক্রেতা চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পোশাক শিল্প মালিক সংগঠনের ওই প্রতিনিধি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ধরনের একজন উদ্যোক্তাকে ভুঁইফোড় শ্রমিক সংগঠন নেতাদের তরফ থেকে অনেক অন্যায্য দাবি মানতে হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে ওনাকে উৎপাদন থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করছেন। শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে আনিসুর রহমান সিনহার ভুলও ছিল। কারখানা পরিচালনায় যে লোকবল তিনি নিয়োগ করেছেন তাদের অব্যবস্থাপনাও বর্তমান দুর্দশার অন্যতম বড় কারণ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন