স্থানীয় কমিউনিটি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে কল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটেনে নানা জাতি ও পেশার মানুষকে রাজকীয় সম্মাননা দেয়ার রীতি রয়েছে। বছরের প্রথম দিন ও রানির জন্মদিন এই দুবার এ সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে নাইটহুড অন্যতম।
এ বছর ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন লুইস হ্যামিল্টনকে নাইট এবং সংগীত শিল্পী ক্রেগ ডেভিডকে এমবিই (মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার) সম্মাননা দেয়া হয়েছে।
স্বীকৃতি দেয়া ১ হাজার ২৩৯ জনের মধ্যে ৮০৩ জনকে স্থানীয় কমিউনিটিতে অবদানের জন্য সম্মাননা দেয়া হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় নিজ সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেছেন।
তবে ব্রিটেনের এই রাজকীয় সম্মাননা কিন্তু অনেকেই গ্রহণ করেননি। এ সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করাদের মধ্যে রয়েছেন- ডেভিড বোয়ি, জন লেনন এবং চলতি সপ্তাহে ঘোষিত তালিকার মাইকেল শিন। শিন ২০১৭ সালে তার ওবিই (অফিসার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার) ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদ এবং ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে দাস ব্যবসার মতো বিষয়গুলোর সংযোগের কারণে তারা এ সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ কারণে এ বছর সম্মাননা কমিটির কিছু সদস্য এই সম্মাননার নাম থেকে ‘এমপায়ার’ (সাম্রাজ্য) শব্দটি বাদ দেয়ার পক্ষে ছিলেন বলে জানা যায়। তবে গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদ অফিসে অনার্স সেক্রেটারিয়েটের প্রধান হেলেন ইওয়েন বলেন, সম্মাননার নাম পরিবর্তনের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে আমরা সম্মাননার তালিকাটি আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করেছি। আমরা আবারো কৃষ্ণাঙ্গ ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়িয়েছি।
ব্রিটিশ রাজের ঔপনিবেশিক অতীতে বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এযাবত সম্মাননা প্রত্যাখ্যানকারী এমন ১২ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হলো:
মাইকেল শিন
চলতি সপ্তাহে হলিউড তারকা মাইকেল শিন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীন মত প্রকাশের অংশ হিসেবে ওবিই সম্মাননা ফিরিয়ে দেয়ার কথা জানান। ২০০৯ সালে ওবিই গ্রহণ করা শেন তার জন্মস্থান ওয়েলশের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর ২০১৭ সালে সম্মাননা ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জর্জ দ্য পয়েট
শিল্পী জর্জ দ্য পয়েট গত বছর ব্রিটিশ সাম্রাজের ‘নারকীয় কর্মকাণ্ডের’ কারণে এমবিএ পদক প্রত্যাখ্যান করেন। লন্ডনে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এ কবি ও র্যাপার বলেন, আমি নিজেকে ব্রিটেনের বন্ধু হিসেবে দেখি। তবে আফ্রিকার ওপর ঔপনিবেশিক আঘাত আমাকে ব্রিটিশ সাম্রাজের খেতাব নিতে বাধা দেয়।
জন লে ক্যারি
সানডে টাইমসে ফাঁস হওয়া রাজকীয় খেতাবপ্রাপ্তদের একটি তালিকায় লেখক জন লে ক্যারির নামও ছিল। তবে এই খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে বিখ্যাত সব উপন্যাস লেখা ক্যারি। তবে তিনি কেন এটি করেছিলেন তা জানা যায়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি মারা গেছেন।
কেন লোচ
চলচ্চিত্র পরিচালক কেন লোচ ১৯৭৭ সালে ওবিই প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ‘শোষণ ও দখলের স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
ড্যানি বয়েল
‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’-এর নির্মাতা অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক ড্যানি বয়েল নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ‘এটি ঠিক আমার নয়’ বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
জন লেনন
ইংলিশ গায়ক ও গীতিকার ১৯৬৫ সালে এমবিই প্রত্যাখ্যান করেন। বিয়াফ্রা যুদ্ধে ব্রিটেনের সম্পৃক্ততা নিয়ে লেনন বলেছিলেন, আমি একজন ব্রিটিশ হিসেবে লজ্জিত।
হাওয়ার্ড গেইল
এই ফুটবল তারকা ২০১৬ সালে এমবিই পদক প্রত্যাখ্যান করেন। এই সম্মাননা গ্রহণকে ব্রিটিশ সাম্রাজের হাতে নির্যাতিত কিংবা মৃত্যুবরণকারী আফ্রিকানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
বেঞ্জামিন সেফানিয়াহ
কবি বেঞ্জামিন সেফানিয়াহ ওবিই খেতাব প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন, আমি গভীরভাবে সাম্রাজ্যবিরোধী। এটি আমাকে হাজার বছরের দাসত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার পূর্বসূরীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করা হয়েছিল।
ডেভিড বোয়ি
সঙ্গীতশিল্পী ডেভিড বোয়ি ২০০০ সালে সিবিই এবং ২০০৩ সালে নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, এ জাতীয় কিছু গ্রহণের ইচ্ছা কখনোই আমার ছিল না। আমি জানিও না যে এটি আসলে কীসের জন্য।
এলজি ব্যালার্ড
ইংলিশ উপন্যাসিক এলজি ব্যালার্ড সিবিই পদক প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, প্রজাতন্ত্রপন্থী হয়ে আমি একজন রানির থেকে এ পদক গ্রহণ করতে পারি না।
ইয়াসমিন আলিভাই-ব্রাউন
সংবাদিক ও লেখক ইয়াসমিন আলিভাই-ব্রাউন মায়ের কথা রাখতে কেবল এমবিই গ্রহণ করেছিলেন। এবং পরবর্তীতে তিনি সেটি আবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি আসলে একটা গাধা ছিলাম। কবি বেঞ্জামিন সেফানিয়াহ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। তাছাড়া মায়ের ভয় ছিল যে আমার এই ঠোঁটকাটা স্বভাবের কারণে আমাদের ব্রিটেন থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতে পারে। কারণ আমরা এখানে এসেছিলাম উগান্ডা থেকে।
জিম ব্রডবেন্ট
অভিনেতা জিম ব্রডবেন্ট ওবিই সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, যারা অন্যকে সত্যিকারের সহায়তা করে শুধু তাদের এ পুরস্কার দেয়া উচিত।
এ সম্মাননা পাওয়াদের তালিকা একবার নতুন বছর শুরুর দিন এবং রানির জন্মদিনে আরো একবার প্রকাশ করা হয়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পকলা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ পর্যন্ত ব্যক্তিদের এ সম্মাননাগুলো দেয়া হয়ে থাকে।
সূত্র: সিএনএন