যার জীবন থেকে শেখা যায়

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

এই ভারতবর্ষে চার এবং ব্রিটেনের মোট পাঁচ পতাকার নাগরিক ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক উল হক (১৯৩৫-২০২০) ব্রিটিশ ভারতের (১৯৩৫-৪৭), ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের (১৯৪৭-৬২), ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের (১৯৬২-৭০), গ্রেট ব্রিটেনের (১৯৭১-৭২) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের (১৯৭২-২০২০) কথা প্রসঙ্গে একদিন বললেন, ‘আমার মধ্যে সর্ববাদী একটা চেতনা কাজ করে এজন্য। হিন্দু লতে ডিস্টিংশনসহ ব্যারিস্টারি পাস করি এবং আমাকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু লর ওপর পাঠদান শুরু।অন্যদিকে করপোরেট কোম্পানি আইনে তার বিশেষ পারদর্শিতার কথা ছিল সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে দিয়ে বিভিন্ন আইনের খসড়া করান, যার মধ্যে একটি আইন ছিলজাতীয়করণ আদেশ, ১৯৭২ আবার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৭-৮১) আমি আদেশ বাতিলের জন্য খসড়া তৈরিতে কাজ করেছিলাম। সবাই জানে, ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনিই শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার আইনজীবী হয়েছিলেন।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বাম পায়ে অস্ত্রোপচার হয়। এর পর থেকে তার স্বাভাবিক হাঁটাচলা ব্যাহত হতে থাকে। মাঝেমধ্যে পায়ে ব্যথা হওয়ার কারণে হুইল চেয়ারে যাওয়া-আসা করতেন। ২০১১ সালে প্রিয়তমা স্ত্রী ডা. ফরিদা হকের মৃত্যুর পর থেকেই নিঃসঙ্গতা অনুভব করতেন তিনি। বার্ধক্য যোগ হয়ে তার সেই নিঃসঙ্গতা আরো বেড়ে যায়। ৪৭/ পুরানা পল্টনেরসুবর্ণাছায়াঘেরা ছায়াশীতল ছিমছাম বাড়িটি তার এত প্রিয় ছিল যে এখান থেকে কোথাও যেতে চাইতেন না তিনি। এনবিএফআই হজ ফাইন্যান্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠা থেকেই আমৃত্যু তিনি ছিলেন এটির বোর্ড চেয়ারম্যান। করোনাকালের আগে হুইল চেয়ারে চড়ে তিনি বোর্ড সভায় যোগ দিতেন। অনলাইনে যখন ভার্চুয়াল বোর্ড সভার আয়োজন শুরু করতে আমরা বাধ্য হলাম, তিনি রসিকতা করে বলতেন, ‘ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ভারচু কীভাবে রক্ষা পাবে সেটা নিয়ে দেখবেন আইনের মারপ্যাঁচ কষাকষি শুরু হয়ে যাবে।এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন ভার্চুয়াল মিটিং কতটা ভার্চুয়াস।

১৯৯৫ সালে রফিক-উল হক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুবর্ণ ক্লিনিক। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডা. ফরিদা হকের স্মরণীয় নামে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীত রূপান্তরিত হয়। ২০১৫-১৭ সালে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ তদারকি ডায়াবেটিক সমিতির কার্যক্রম কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনার জন্য প্রায় শুক্রবার আমরা চন্দ্রায় তার বাগানবাড়িতে যেতাম। দুপুরে বেশ মজাদার ভূরিভোজ হতো আর চলত নানা কথামালার ফুলঝুরি। সেখানে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সাক্ষাত্কার নিতে আসতেন ইলেকট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়ার মানুষ। তাদের সঙ্গে আমরাও জানতে পারতাম, শুনতে পারতাম তার অনেক অভিজ্ঞতার বয়ান। স্বাস্থ্য খাতের প্রতি তার এমন আন্তরিক আগ্রহ কেন জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘আমার বাবা ডাক্তার, চাচা ডাক্তার, ভাই ডাক্তার, স্ত্রী ডাক্তার, তাদের ভিড়ে আমি এবং পরবর্তীকালে আমার একমাত্র ছেলে আমরা শুধু আইন ব্যবসায়। আমার চাচার চোখের বড় চিকিৎসালয় ছিল। আমার আব্বা সেটা দেখাশোনা করতেন। সেই সূত্র ধরে ঢাকায় ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতালের উত্পত্তি। সেই থেকে স্বাস্থ্য খাতের প্রতি আমার দুর্বলতা।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জমি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে মোটা অংকের (৫০ লাখ টাকা) ট্রাস্ট ফান্ডপ্রাপ্তিতে সরাসরি ভূমিকা ছিল ব্যারিস্টার রফিকুল-উল হকের। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক তার স্ত্রী ডা. ফরিদা হক। অধ্যাপক ইব্রাহিমের দুই কন্যা প্রফেসর হাজেরা মাহতাব প্রফেসর কিশোয়ার আজাদ ছিলেন ডা. ফরিদা হকের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সে সুবাদে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ফরিদা হক। আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন যশোরের হাবিবুর রহমানের মেয়ের জামাই হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে জামাই জানতেন এবং সে সুবাদে তিনিও আকিজ আদদ্বীন পরিবারের অন্যতম অভিভাবক পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। ছিলেন আদদ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। আদদ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থায়ন সূত্রে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে যশোরের নাভারণে আকিজ কলেজিয়েট স্কুলের বার্ষিক কনভোকেশনে যোগ দিয়েছি দুবার। পথে তার জীবন থেকে শেখা কত কাহিনী শুনেছি।

তার কলেজ লাইফ ছাত্রজীবনে রাজনীতিসংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতেন, ‘আমার কলেজ লাইফ হচ্ছে ইসলামীয়া কলেজ। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামীয়া কলেজে। থাকতাম বেকার হোস্টেলে। ওখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন। আমি যে রুমটাতে ছিলাম, তার পাশের দুটো রুমেই বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম উদ্বোধন করতে। ২৬ ২৭ নম্বর রুম এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। আমি পাশের ২৪ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার ভাইয়েরাও ওখানে থেকেছে, আমিও ওখানে থেকেছি। তারপর ইউনিভার্সিটি জীবনে কারমাইকেল হোস্টেলে থেকেছি। ওখানেও শেখ সাহেব কিছুদিন ছিলেন। ইউনিভার্সিটিতে আমি রাজনীতি করতাম, সোস্যাল সেক্রেটারি ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে জিতেছিলাম। তখন মুসলমান ছাত্র তো আমরা মাত্র চার-পাঁচজন। তার পরও আমি অনেক ভোটে জিতে গেলাম। এর পরেরবার সবাই মিলে আমাকে হারাবে বলে ঠিক করল। আমার কাজ ছিল ছাত্রদের বই, ক্যান্টিন ট্যুরের ব্যবস্থা করা। তখন রাস্তার পলিটিকসে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যুব কংগ্রেস করতাম। কংগ্রেস বলতে ন্যাশনাল পলিটিকস না। আমি তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন আমার নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সেন্ট্রাল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আর আমি ছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গলে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, বহুবার মিটিং হয়েছে, কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা খুব বড় মিটিং করেছিলাম সল্টলেকে, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বিধান রায় ছিলেন। সে আরেক ইতিহাস। কলকাতায় পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিলেন ভারতের [সাবেক প্রয়াত] রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

১৯৭২ সালে সম্ভবত বঙ্গবন্ধু সরকারি সফরে রাশিয়া যাবেন। দারুণ শীতের দেশে ওভারকোট পরিধান আবশ্যক। বঙ্গবন্ধুর ওভারকোট ছিল না, চটজলদি বানানোর সময়ও ছিল না। অগত্যা ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ওভারকোটটা বঙ্গবন্ধু নিলেন। দেশে ফিরে সেটি ফেরত দিতে গেলে তিনি ফেরত নিলেন না। বললেন, বঙ্গবন্ধুর গায়ে শোভা পাওয়া কোট তিনি কীভাবে নেবেন? ওভারকোটটি তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে দিয়ে দেন।

তার সঙ্গে ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলে, আহছানিয়া মিশনের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে, হজ ফাইন্যান্সের বোর্ডে, আদদ্বীন ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট আদদ্বীন মহিলা কলেজের সমাবর্তনে একসঙ্গে কাজ করেছি। তার স্নেহ-সাহচর্য লাভ করেছি। তিনি ছিলেন আইনকানুনের চলন্ত বিশ্বকোষ। তার পরিচালিত প্রায় ৫০০ মামলা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো মামলায় তিনি ব্যাপক পড়ালেখা করে, প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। তিনি ভারতের রামজিত মালানীর মতো কোনো মামলায় হারেননি। আমরা মাঝে মাঝে জেনেছি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ের খসড়া ছিল তার। সবার সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক ছিল। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেও ছাড়তেন না। স্পষ্টভাষী ছিলেন, মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিতেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে তিনি ছিলেন ত্রাতা, অনেক শিক্ষিত আত্মীয়কে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। তারা ধন্যবাদ দিতে এলে শুধু বলেছেন সৎ থাকতে, মাথা ঠিক রাখতে। সততাটা তার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল। নিজে সততাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছেন। তাই তো দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে সম্মানও পেয়েছেন। তিনিই এমাত্র আইনজ্ঞ, যিনি একাধারে বহু রাষ্ট্রনায়কের সম্মান সমীহ লাভ করেছিলেন। পরিচিতজনদের বলতেন, ‘জানিস, আমি ভাবছি দুই ম্যাডামকে আমার বাড়িতে এনে একটা ঘরে বন্ধ করে দিয়ে বলব, দেশের প্রশ্নে আপনারা একমত না হওয়া পর্যন্ত দরজা খুলব না। কিন্তু সমস্যা আসলে ওদের মধ্যে না, আমি বললেই ওরা একমত হবেন, আমার কথায় না করতে পারবেন না, কিন্তু সমস্যা ওদের নিচের নেতাগুলোকে নিয়ে।পাকিস্তানের প্রবাদতুল্য আইনজীবী একে ব্রোহি (১৯১৫-৮৭) তাকে বেশ স্নেহ করতেন। তাকে দিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করিয়েছিলেন। এসব মামলায় তিনি মোটা অংকের সম্মানী পেয়েছিলেন। শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী হিসেবে প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে প্রচুর টাকা আয় করেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সেই টাকার একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়, মানুষের কাজে। নানা জায়গায় হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, দিয়েছেন বড় বড় অংকের অনুদানও। তার কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ ফিরে গেছে, এমন নজির নেই বললেই চলে। তিনি বলতেন, ‘আমি আমার উত্তরসূরিদের জন্য একটি টাকাও ব্যাংকে রেখে যেতে চাই না। মানবতার সেবায় সবকিছু ইনভেস্ট করতে চাই।

২০১৭ সালে খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আমার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে দেখেই বললেন, ‘যাক স্বর্ণপদকের নিরাপত্তা বিধায়করে পাওয়া গেল।আমি এনবিআরে, আমার স্ত্রী তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্টে। দেখা হলেই বলতেনএকজন রাজস্ব আয় করে, আরেকজন সেটার লন্ডারিং ঠেকায়।সদাসজীব সহাস্য ছিলেন এই প্রবীণ আইনজীবী। অথচ তিনি নিজে ছিলেন একজন ক্যান্সার সারভাইভার। স্টমাক ক্যান্সার হয়েছিল তার। ১৯৮৬ সালে অপারেশন হয়েছিল। স্টমাকটি অপসারণ করা হয়েছিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। একই সঙ্গে তার বাঁ পাঁজরের তিনটি হাড়ও অপসারণ করতে হয়েছিল। এরপর আমৃত্যু সুস্থ ছিলেন। তার পরও তার মধ্যে উচ্ছলতার কমতি ছিল না।

 

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন