ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুকুর নিধন বিতর্ক ও সমাধান

নাহিদা ফারজানা কলি

‘ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে হাজার হাজার কুকুর’— সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাণিপ্রেমীদের প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয় প্রাণিপ্রেমী ও প্রাণিপ্রেমী সংগঠনসমূহ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘ঢাকা শহর থেকে ৩০ হাজার কুকুর শহরের বাইরের লোকালয়ে স্থানান্তরিত করতে যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কুকুরগুলোকে মাতুয়াইল এলাকায় স্থানান্তরিত করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে কুকুরগুলো খাবারের সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সেটা বাতিল করা হয়েছে।’

প্রাণি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটিতে মোট ৩৭ হাজার কুকুর রয়েছে। বেওয়ারিশ কুকুর (কুকুরবিদ্বেষীদের ভাষ্যমতে) নিয়ে এক পক্ষের দাবি, রাস্তায় কুকুরের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ, সময়-অসময়ে কুকুর মানুষকে তাড়া করে। অন্যপক্ষের দাবি, শহর থেকে কুকুর তাড়িয়ে দেয়ার চিন্তা শুধু অমানবিকই নয় বেআইনিও বটে। 

সিদ্ধান্তের সূত্রপাত

গত ৩০ জুলাই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকাবাসীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।’ ওই বক্তব্যের প্রায় চার সপ্তাহ পর দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনসংযোগ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি অনলাইন গণমাধ্যমে সংবাদপ্রচার করা হয়। এরপরই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, গড়ে ওঠে পক্ষ-বিপক্ষ।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আব নাছের বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকা শহরের বেশকিছু এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে কুকুর-সম্পর্কিত নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অনেকে বলছে যে, কুকুরে কামড়াচ্ছে, অনেকে বলছে বাসা থেকে বের হতে পারছি না, বাচ্চাকাচ্চারা ভয় পাচ্ছে, আসলে নাগরিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ কর্তৃপক্ষ জানায়, সমপ্রতি কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ প্রকল্পে ত্রুটি দেখা দেয়ায় এদের বংশবৃদ্ধি হওয়ার কারণে ঢাকার রাস্তায় হঠাত্ করেই কুকুরের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। 

কুকুর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বন্ধ

সিটি করপোরেশনের আদিম নৃশংসতায় পিটিয়ে কুকুর নিধন করার রেওয়াজ থাকলেও ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচার কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেয়া হয়। আদালতের এ নিষেধাজ্ঞার পর ২০১২ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধ টিকা দেয়ার জন্য চুক্তি/সমঝোতা করে। ২০১৪ সালে চুক্তির/সমঝোতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) আর মেয়াদ নবায়ন করেনি। 

ডিএসসিসির ভেটেরিনারি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কুকুর বন্ধ্যাকরণের একটি প্রকল্পর মাধ্যমে ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে ছয় মাস এই কার্যক্রম চালানো হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কত কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে, কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য ভেটেরিনারি বিভাগের কাছে নেই। এই বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চের পর বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখতে আর কোনো কার্যক্রম নেয়া হয়নি। 

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৯ মাস ধরে কুকুর বন্ধ্যাকরণের কাজ বন্ধ রয়েছে। আর উত্তর সিটিতে এই কাজটি গত ৯ মাস বন্ধ আছে। অন্যদিকে কুকুর নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমও থেমে আছে। একদিকে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে। এতে কুকুরের আক্রমণের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩ লাখ লোক কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের হিসাবে, ওই হাসপাতালে প্রতিদিন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার দুই শতাধিক মানুষ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিত্সা নিতে আসছে। ২০১৮ সালে কুকুরের আক্রমণে আহত ৮১ হাজার, ২০১৯ সালে ৭৬ হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬ হাজার লোক কুকুরের আক্রমণের পর সেবা নিয়েছেন। 

তবে, প্রাণিপ্রেমী বিভিন্ন সংগঠন বলছে, সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়েছে। স্থানান্তর না করে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়ার দাবি তাদের। ডিএসসিসির ভেটেরিনারি কর্মকর্তা এ বি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কুকুর স্থানান্তর কোনো সমাধান নয়। সরিয়ে ফেললেও দেখা যাবে কুকুর আগের জায়গাতেই আবার ফিরে আসবে।’

বন্ধ্যাকরণে নয়, ভ্যাকসিনে আগ্রহী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একদিকে কুকুর অপসারণ নিয়ে ব্যস্ত হলেও, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কুকুর বন্ধ্যাকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে, বন্ধ্যাকরণের চেয়ে ভ্যাকসিনে আগ্রহী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০২০ সালের মধ্যে দেশ থেকে স্থায়ীভাবে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির আওতায় চারটি কর্মকৌশল নির্ধারণ করে। এগুলো হচ্ছে জলাতঙ্ক রোগ এবং এর চিকিত্সা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম জোরদার করা, কুকুরের কামড়ের আধুনিক চিকিত্সা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, ব্যাপক হারে কুকুরের শরীরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান এবং লাইগেশন ও খোজাকরণের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। তবে গত ৯ বছরে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজটি শুরুই হয়নি।

গত বছর জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৮ হাজার ৫১২টি বেওয়ারিশ কুকুরকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৪২ হাজার ৯৩৫টি কুকুরকে গত বছরের মে মাসে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা (প্রথম বার) দেয়া হয়। দ্বিতীয় টিকা দেয়ার কথা ছিল চলতি বছরের মে মাসে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শাহনীলা ফেরদৌসী প্রথম আলোকে বলেন, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কুকুর বন্ধ্যাকরণের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। কিন্তু এই খাতে কখনোই কোনো টাকা বরাদ্দ হয়নি। ভ্যাকসিনেশনের জন্যই নিয়মিত বরাদ্দ থাকছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কুকুর বন্ধ্যাকরণ

ডিএনসিসি কুকুর বন্ধ্যাকরণের জন্য ‘অভয়ারণ্য’ নামে একটি এনজিওর সঙ্গে আগের করা চুক্তি নতুন করে নবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডিএনসিসি একই সঙ্গে তার সীমানায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কুকুর বা যে কোনো প্রাণি অপসারণ কিংবা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলে জানতে পারলে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘কুকুর স্থানান্তর করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ২০১৯ সালের আইনে কুকুর বা বন্যপ্রাণিকে কীভাবে দেখতে হবে, সে সমপর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আমাদের মহাখালীতে যে মার্কেট রয়েছে, সেখানে কুকুরের জন্য আমরা একটা হাসপাতাল করেছি। আমি নিজেও করোনার সময় বিভিন্ন স্থানে কুকুরকে খাবার দিয়েছি। কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করতে হবে। তাদের জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিতে হবে।’

প্রাণিপ্রেমী বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা

২০১২ সালে উচ্চ আদালত কুকুর নিধনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারির পর ওই বছরের মার্চ মাসে অভয়ারণ্য নামে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে চুক্তি করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ওই বছর ১ এপ্রিল থেকে তারা  চুক্তির শর্তানুযায়ী বেওয়ারিশ কুকুর নিধন না করে বন্ধ্যাকরণ এবং টিকাদানের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কুকুর নিয়ন্ত্রণ করে। রাজধানীর রাস্তাঘাটে কুকুরের বংশ বিস্তার রোধে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো উত্তর সিটির বসিলা এলাকায় অভয়ারণ্যের নিজস্ব ক্লিনিকে নিয়ে বন্ধ্যা করে ছেড়ে দেয়। এ কাজের জন্য অভয়ারণ্যকে বিনা মূল্যে ওষুধ, যন্ত্রপাতি এবং অর্থ প্রদান করে সরকার। এ বাবদ দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দৈনিক খরচের ভিত্তিতে প্রতি মাসে অভয়ারণ্যকে ৮০ হাজার টাকা করে দেয়া হতো বলে জানা গেছে। পরে চুক্তি শেষ হওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলিসহ সর্বত্রই বেড়েছে পথকুকুরের সংখ্যা। এছাড়া, অন্যান্য প্রাণিপ্রেমী সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে কুকুরপ্রেমীরা মাঝেমধ্যে রাস্তার কুকুরের বন্ধ্যাকরণের কাজে নিয়োজিত হয়।

আইনি প্রক্রিয়া

এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ও ধানমন্ডি এলাকা থেকে কিছু কুকুর সরিয়ে মাতুয়াইলে ফেলে রেখে এসেছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও, আরো কয়েকটি এলাকা থেকে কুকুর ধরা হয় এবং ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়; যদিও তখন মানববন্ধন কর্মসূচি চলছিল এবং সিটি করপোরেশনের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল।  প্রাণিপ্রেমী সংগঠনগুলো দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়রের সঙ্গের বৈঠকে যে বক্তব্য উপস্থাপন করে,  সেখানে দেখানো হয়েছে— কুকুর নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে সমস্যা রয়েছে সেগুলোর প্রতিকার কীভাবে সম্ভব, কেন অপসারণ অকার্যকর ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

২০১৪ সালে রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে কুকুর নিধন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রাণিকল্যাণ সংগঠন ‘অভয়ারণ্য’র সভাপতি রুবাইয়া আহমেদ, পিপলস ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল ও অভিনেত্রী জয়া আহসানের পক্ষে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব। কুকুর স্থানান্তর ও ডাম্প করার বিষয়ে ডিএসসিসির কার্যক্রমের বৈধতা প্রশ্নে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। রিটে ডিএসসিসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। পরে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব বলেন, ‘কুকুর নিয়ে আলোচনা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালত কুকুর নিধন না করতে মৌখিক আদেশ দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে এ বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন আদালত।’

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী সাকিব মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী কুকুরসহ বেওয়ারিশ প্রাণি অপসারণ করা যাবে না। অথচ টিএসসি ও ধানমন্ডি থেকে বেওয়ারিশ কুকুর তুলে নিয়ে মাতুয়াইলে ছেড়ে দিয়েছে ডিএসসিসি, যা আইন সমর্থন করে না।

অপরদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী, কুকুর নিধন ও অপসারণ বেআইনি। সরকারি কোনো সংস্থা এটি করে থাকলে সাংবিধানিক অধিকার বলে, যে-কেউ উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত বলে আমি মনে করি।’

জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের জানান, এ বিষয়ে তিনি কোনো সরকারি আদেশ সম্পর্কে জানেন না। জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএসসিসি থেকে কুকুর অপসারণের ব্যাপারে মেয়রের ‘ইচ্ছা’ নিয়ে সিদ্ধান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ছিলেন। তিনি জানান, প্রাণিকল্যাণ আইনের যে ধারায় স্থানান্তর নিষিদ্ধ করেছে তা ব্যক্তি বা সংস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুসারে তৃতীয় তপশিলের ১৫.৩, ১৫.৪, ১৫.৫ ও ১৫.১০ এবং পঞ্চম তপশিলের ৫১ ধারা ও সপ্তম তপশিলের ১৮ ধারা অনুযায়ী সিটি করপোরেশন কুকুর স্থানান্তর করতে বা এমনকি নিধনও করতে পারে।

নিরীহ প্রাণি কুকুর বরাবরই প্রভুভক্ত। বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিটি প্রাণিরই আছে। তাই ওদের প্রতি ন্যূনতম মানবিক আচরণ দেখানো আমাদেরই  দায়িত্ব। দেওয়ালে পথকুকুরদের ছবি এঁকে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি ‘প্রাণবিক ঢাকা’ গড়ে তোলার দাবিতে পথে নেমেছেন কুকুরপ্রেমীরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় কুকুর নিধনের পথে না গিয়ে স্থানান্তর ও বন্ধ্যাকরণের পথে হাঁটছে দুই সিটি। কুকুর নিধন, স্থানান্তর না করে কুকুরকে গলায় বন্ধনী দিয়ে চিহ্নিতকরণ, নিবন্ধন, মাঝেমাঝে পথকুকুরকে খাবার দেয়া, ভ্যাকসিন দেয়া ও বন্ধ্যাকরণ করতে হবে। এসব করে কুকুরের সংখ্যা কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আনা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ্জামান বলেন, ‘যে কোনো সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে নেয়া উচিত। পথকুকুর আবর্জনা খুঁটে খায়, এরা বাস্তুসংস্থানের উপকার করে। আবার সমস্যার কারণও হতে পারে। যদি কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণের দরকার হয়, জরিপ চালিয়ে এবং বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।’ পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কুকুর অপসারণ করে ঢাকা শহরে কুকুর কমানো সম্ভব নয়। এর পরিবর্তে কুকুর বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে বংশবৃদ্ধি বন্ধ হয়। কুকুরকে বন্ধ্যাত্বকরণ টিকা দিলে কুকুরগুলো আর বেশি লাফালাফি বা চঞ্চল হয়ে ওঠে না। এটা কুকুরের স্বভাব। ফলে বিশৃঙ্খলাও হয় না।’

তথ্যসূত্র

 ১. সব ‘দায় কুকুরের’, প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

২. বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে বেকায়দায় ঢাকা, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

৩. আপাতত কুকুর অপসারণ বন্ধ রাখতে বললেন হাইকোর্ট, risingbd.com, ১২ অক্টোবর ২০২০

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন