ক্যাডার-বৈষম্য

প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূতকরণ নিয়ে কিছু কথা

মাছুম বিল্লাহ

আগের সচিবালয় ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর ট্রেড, তথ্য সমবায় ক্যাডার সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারে আসার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। তারা কারণ হিসেবে বলেছেন যে নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, বৈষম্য বিরাজ করছে এবং পদোন্নতি ঠিকমতো হচ্ছে না বিধায় তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী একটি ক্যাডার বিসিএস প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হওয়ায় কমসংখ্যক পদের ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ২৫ ক্যাডারের মধ্যে তিন ক্যাডারের নেতারা সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রশাসন ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের যোগ্যতা সামর্থ্য অনুযায়ী যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবদানও রাখতে পারছেন না। নানা বঞ্চনার কারণে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরির মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ক্যাটাগরি বা গ্রুপ হচ্ছে পড়ুয়া, ভালো ছাত্রঅনেকে যাদের আতেলও বলে থাকেন। তারা নিজের বিষয় পড়াশোনা, শিক্ষকদের সঙ্গে একটু খাতির রাখা, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রোগ্রাম কিংবা সামাজিক কোনো কাজে এদের ব্যতিক্রম ছাড়া খুব একটা দেখা যায় না। জীবনে এদের মূল একটি উদ্দেশ্য থাকেবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া, বিদেশে যাওয়া, পিএইচডি করা। আরেক দল, যারা সবসময়ই সাধারণ জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, পেপার নিয়মিত পড়েন আর বিসিএসের কিছু গাইড পড়েন। তারা নিজ বিষয়ের এত গভীরে ঢুকেন না, ঢুকতে চান না। তাদের টার্গেট হচ্ছে জীবনে বিসিএস অফিসার হওয়া। আরেক দল আছে, যারা বিষয় পড়া কিংবা বিসিএস গাইড পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা তো দূরের কথা, ক্লাসও করেন না। তারা পড়ার মধ্যে পত্রিকা পড়েন, রাজনৈতিক সংবাদগুলো পড়ে থাকেন, মিটিং-মিছিল করেন, সিনিয়র ছাত্রনেতাদের সঙ্গে, জাতীয় নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করার চেষ্টা করেন এবং করেন। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনে রাজনীতিবিদ হওয়া। তারা মনে করেন রাজনীতিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাদের রাজনীতি করতে হবে। তাদের আশেপাশে যারা আতেলের মতো শুধু পড়াশোনা করছেন কিংবা বিসিএস অফিসার হওয়ার জন্য এত সাধারণ জ্ঞান গাইড বই পড়ছেন, তাদেরকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন। কাজেই বিষয়ের পড়াশোনা তাদের এত দরকার কী?

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে পদের চেয়ে বেশি কর্মকর্তা আছেন, তার পরেও তাদের পদোন্নতি নিয়মিত হচ্ছে। অন্যান্য ক্যাডারেও তারা কাজ করছেন। সুবিধা বিসিএসের অন্যান্য ক্যাডারে নেই। তথ্য, খাদ্য, ট্রেড, সমবায় পরিসংখ্যান ক্যাডারে নতুন পদ সৃষ্টি পদোন্নতির প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ফলে যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি  থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার শিক্ষা, তথ্য ট্রেড ক্যাডারে পদ খালি থাকা সত্ত্বেও সঠিক সময়ে পদোন্নতি হচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ক্যাডারে নিয়মিত নিয়োগই হয় না। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যগুলোয় পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। ফলে অন্যান্য ক্যাডারে দক্ষতা বৃদ্ধিসহ ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়েও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের পদ সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বলা যায়, এক ধরনের উল্টো চিত্র বিরাজ করে প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে। যেখান কাজের পরিধি বাড়ছে, সেখানে ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্য বাড়ার কথা, কমবে কেন? জনগণ তো এমনিতেই সেবা পায় না, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে একজন কর্মকর্তাকে এত বেশি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় যে তিনি অনেক প্রার্থীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারেন না এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না।

বিভিন্ন ক্যাডারের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নীতির কারণে দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। যোগ্যতা সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের জন্য পুরোপুরি অবদান রাখতে পারছেন না ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কমসংখ্যক পদের ক্যাডার কর্মকর্তারা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। ফলে বিসিএস ট্রেড ক্যাডারের ৩২টি পদে ২৪ জন কর্মকর্তা, সমবায় ক্যাডারের ১০০ জন কর্মকর্তা, তথ্য সাধারণ ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান বার্তা বিভাগের ৩১৬ জন, খাদ্য ক্যাডারের ১৫০ জন কর্মকর্তাও প্রশাসনে একীভূত হতে চান। ৩২টি পদ নিয়ে ট্রেড ক্যাডার দেশের জন্য অবদান রাখতে পারছে না। কল্যাণের জন্য করা হলে এর সংখ্যা বাড়াতে হবে, তা না হলে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। ট্রেড ক্যাডারের পদগুলোয় এখন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। একই প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়ার পরও ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে কাজের সুযোগ পান না। ফলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন প্রশাসনের সঙ্গে একীভূত হলে বিলম্বে হলেও তারা উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব সচিব হতে পারবেন। সম্প্রতি ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা একীভূত হয়ে পদোন্নতি পাওয়ার ফলে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশের সূচনালগ্নে ২৯ ক্যাডার করা হয়েছিল, যাতে প্রত্যেক ক্যাডার স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ পান। -যাবৎ গঠিত সব প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি ক্যাডার সংখ্যা কমিয়ে আনতে সুপারিশ করেছে। ২০১২ সালের নভেম্বর পরিকল্পনা বিভাগের দারিদ্র্য বিশ্লেষণ পরিবীক্ষণ অনুবিভাগ আয়োজিত ষষ্ঠ (২০১১-১৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন সম্পর্কিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারের ২৮ ক্যাডার বিলুপ্তির পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ২৮টি ক্যাডার না রেখে এদের পাঁচ থেকে ছয়টি ক্লাস্টারে বিভক্ত করা হবে। ক্যাডারের সংখ্যা কমানো হলে সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম আরো ত্বরান্বিত হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মাত্র দুটি ক্যাডারই যথেষ্ট। একটি হবে সাধারণ ক্যাডার, অন্যটি টেকনিক্যাল ক্যাডার। যেমন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য। ফুড ক্যাডারে এন্ট্রি পদ হচ্ছে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক বা এসি ফুড। পদের সংখ্যা ৬৯টি। অথচ পদে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৭ জন। সমবায় একটি ছোট ক্যাডার। আশির দশকে যে কয়েকটি পদ নিয়ে ক্যাডারটি যাত্রা শুরু করেছিল, পদের সংখ্যা আর বাড়েনি। বিসিএস পাস করে সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপজেলা পর্যায়ের পদ বা প্রারম্ভিক পদ অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ শুরু করার কথা ছিল, কিন্তু তারা কাজ করেন জেলা পর্যায়ের পদ ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। অর্থাৎ এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার দিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কাজ চালানো হচ্ছে। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর ১০০ পদ নিয়ে ট্রেড ক্যাডার গঠন করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ১১২ পদ ১৯৯৪ সালে ১১৬টিতে উন্নীত হলেও বিদেশে বাণিজ্যিক মিশনসহ বিভিন্ন পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ায় ক্যাডারের পদ ৩২- নেমে আসে। জেলা উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ডিসি ইউএনওরাও খাদ্য বিভাগের অনেক কাজ করছেন। একীভূত হলে খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারবেন। প্রয়োজনের তাগিদে এসব ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়েছিল, কাজেই সবার বিষয়েই সরকারের আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। কোনো একটি বিশেষ ক্যাডার দুর্বল হলে ওই সেক্টরটিই দুর্বল হয়ে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে চাকরি মানেই হচ্ছে বিসিএস অফিসার হওয়া। বিভাগের ক্লার্ক, পিয়ন, অফিসার তারাও দেখতাম বলতেন, স্যার তো আর কয়েক দিন পরেই বিসিএস দিয়ে ম্যজিস্ট্রেট হবেন। আর বিসিএস দেয়া মানেই ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া। ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া মানে এক ধরনের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, দাম্ভিকতা এবং সমাজের এক সম্মানিত পজিশন দখল করা। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রশাসনিক পদে চাকরি করা এক ধরনের প্রেস্টিজ সিম্বল- পরিণত হয়েছে। তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিসিএস প্রশাসনকে গুরুত্ব দেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের হাজার হাজার পদের চাকরির বিপরীতে কয়জন প্রশাসনে যেতে পারেন বা যাওয়ার সুযোগ আছে? যারা যাচ্ছেন তারা প্রচলিত অর্থে হয়তো ভাগ্যবান (?), কিন্তু বাকি হাজার হাজার মেধাবীর জায়গা কোথায়? আর প্রশাসনিক পদে কেন যেতে চান, তার কারণ তো সবারই জানা। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল তিন ক্যাডারের প্রশাসন ক্যাডারে সংযুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। একটি ক্যাডারের হাতে সব ক্ষমতা প্রদান করা, সেটিকে রাজকীয় ক্যাডার মনে করা, পুরনো ধ্যান-ধারণা জিইয়ে রাখা আধুনিক প্রশাসনের কোনো লক্ষণ নয়। ব্রিটিশরা তাদের প্রয়োজনে প্রশাসন যন্ত্রকে সেভাবে সাজিয়ে ছিল, পাকিস্তান আমলে সেগুলোর প্রায় সবটাই বহাল ছিল, পাকিস্তান-পরবর্তী সময়ে এর পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সেগুলো খুব কাজের পরিবর্তন নয়। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলতেন, মুজিব কোট পরে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সিএসপিদের নির্দেশ দিলে, কিছু করতে বললে তারা কথা শোনেন না। সিএসপিরা মনে করতেন তারা দেশের সেরা ছাত্র, মেধাবী ছাত্র। পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে তারা চেয়ারে বসেছেন। যারা রাজনীতি করেন, তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পড়ালেখা করেন না, তাদের কথা কেন শুনতে যাব। তাই অনেক মন্ত্রীও তার সচিবদের ভয় পেতেন। অবস্থা এখন পাল্টেছে, পাল্টানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যেভাবে পাল্টেছে, সেটি কাম্য নয়। এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর মাঝে মাঝে হঠাৎ করে সচিবালয়ে যেতেন, শুনেছি সচিবরা মাথা নিচু করে সচিবালয়ে ঢুকতেন, বিশেষ করে যাদের বিলম্ব হতো।

বিসিএসে আবার দেখা যাচ্ছে প্রচুর পরিশ্রম করা একজন শিক্ষার্থী অলরাউন্ডার। দেখা গেল প্রশাসন ক্যাডারে তার নাম আসেনি। ফলে নীরবে হতোদ্যম হয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর এভাবে পাওয়া যায়, বিসিএসে হয়েছে, তবে তথ্য ক্যাডারে। কাজেই আবার বিসিএস দিতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে কোনো আকর্ষণ নেই, মাদকতা নেই, উৎসাহ নেই। এটি কেন হবে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও যদি আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারি তাহলে তো বলতে হবে এখানে বড় সমস্যা রয়ে গেছে!

 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন