অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত ভূমি আইন : তাৎপর্য, সম্ভাবনা ও উৎকণ্ঠা

জাহিদ অয়ন

ভূমিকা

সম্প্রতি, আইন কমিশন বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে ভূমি আইন, ২০২০-এর খসড়া খসড়া আইনটি সকলের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট এবং সুসংহত আইনের অভাব শত বছরের বস্তুত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সরকার বা ব্রিটিশ সরকার থেকে পাকিসত্মান প্রশাসন কেউই ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করেনি; তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুনাফালাভ স্বার্থসিদ্ধি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেকেও সেই ঐতিহাসিক দায় নিয়ে পথ চলতে হয়েছে বহু বছর বাংলাদেশের বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন আইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাই সুনির্দিষ্ট সুসংহত ভূমি আইনের অবতারণা যেন শত বছরের আইন বিজ্ঞানে এক আকাঙ্ড়্গিত অগ্রগমন তবে সম্ভাবনা ছাপিয়ে নতুন ভূমি আইনের খসড়া বিভিন্ন উত্কণ্ঠারও জন্ম দিয়েছে দেওয়ানি আদালতের চাপ কমানোর মহত্ উদ্দেশ্য বাসত্মবায়নে আইনটি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের হাতে অরক্ষিত ক্ষমতা দিয়ে ফেলেছে, যা গণতান্ত্রি রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্যকে হুমকির সম্মুখীন করেছে তাই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে খসড়া আইনটির তাৎপর্য, সম্ভাবনা এবং একই সঙ্গে কিছু উৎকণ্ঠার দিক এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো

তাৎপর্য
বঙ্গদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহাসিকভাবেই অঞ্চলের মানুষের সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভূমি কেননা, এখানকার জমি ভীষণ উর্বর; একই সঙ্গে বিভিন্ন সম্পদ, প্রাচুর্যে ভরপুর যতদূর জানা যায়, দূর অতীতে বাংলায় ভূমির ব্যক্তি মালিকানার ধারণা ছিল না একটি নির্দিষ্ট গ্রাম বা এলাকা সম্পূর্ণভাবে একটি সম্প্রদায়ের অধিকারে থাকত তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভূমি বণ্টনের মাধ্যমে আবাসন, কৃষি কাজ অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত সামষ্টিক সম্পদ যেমন জলাশয়, বন কিংবা পথ ইত্যাদিতে সকলের সমান অধিকার থাকত এবং সকলে মিলেই সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করত আর্যদের আগমনের পর কেন্দ্রীয়ভাবে উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ কর হিসেবে গ্রাম প্রধানের মাধ্যমে আদায় করার ইতিহাস পাওয়া যায় কিন্তু তখনো ভূমি অধিকারের ধারণা কিংবা ভূমি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয়করণে প্রচলিত ব্যবস্থায় কোনো হসত্মক্ষেপ করা হয়নি

সম্রাট আকবরের শাসনাামলে তখনকার অর্থমন্ত্রী টোডারমল ভূমি ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন অগ্রগতি সাধন করেন তার করা ১০ বছর দীর্ঘ ভূমি জরিপ পরবর্তী ৭৬ বছর পর্যন্ত্ম কার্যকর ছিল তিনি ভূমির ধরন অনুযায়ী কর নির্ধারণের সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করেন মোগল আমলেই ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়মিত কার্যক্রম সম্পাদনার জন্য বিভিন্ন পদে নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়; জমিদার মূলত মোগল আমলে তৈরি করা একটি নির্বাহী পদ, যার কাজ ছিল সম্রাটের পক্ষে কর আদায় করা

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতার কলকাঠি হাতে পাবার পর তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুনাফালাভ ভূমি উন্নয়ন বা উপমহাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাদের নজরে ছিল না ছাড়াও, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক ব্যবধানের কারণে তারা প্রথমত উপমহাদেশে ঐতিহাসিকভাবে ক্রমবিকশিত ভূমি ব্যবস্থাপনাকে এক. কিছুটা ভুল বুঝেছে, দুই. সঠিকভাবে বুঝতে চায়নি; বরং ইংরেজি ভূমি ব্যবস্থাপনার একটি পরিমার্জিত রূপ ভারতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে বা করেছেও এর ফলে ইংরেজি সামন্ত প্রথা বাংলায় মধ্যস্বত্বভোগরূপে আবির্ভূত হয় মোগল আমলের কর আদায়ের কর্মকর্তা হিসেবে যারা নিযুক্ত ছিলেন সেই জমিদারদেরকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত নির্দিষ্ট অঙ্কের কর আদায় সাপেক্ষে ভূমির মালিকানা প্রদান করে আর এভাবেই গ্রামভিত্তিক ভূমির মালিকানা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কোম্পানির হাতে চলে যায়

কোম্পানি জমিদারদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আদায় করলেও, জমিদারদের জন্য কর আদায়ের কোনো সীমা বাঁধা ছিল না কোম্পানি জমিদারি প্রতি প্রায় দেড় কোটি টাকা আদায় করলেও, জানা যায়, জমিদাররা ক্ষেত্রবিশেষে কৃষকদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকাও আদায় করেছে এর ফলে অঞ্চলের কৃষকেরা ক্রমেই ভূমিহীন, দরিদ্র হয়ে পড়ে অপরপক্ষে, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা না থাকায়, জমিদাররা অর্থ ব্যক্তিগত বিলাসিতায় খরচ করেছেন, রাষ্ট্রের ভূমি উন্নয়ন আর হয়নি জানা যায়, সেই আমলে বিলেতি সামগ্রীর নিয়মিত ক্রেতা হয়ে উঠেছিলেন বাংলার নব্য ধনবান ব্যক্তিরা; অথচ এই বিলাসিতার অর্থের জোগান দিয়েছে বাংলার নিপীড়িত নিষ্পেষিত কৃষক বিলেতি সামগ্রী ক্রয়ের এই প্রবণতাই পরে স্বদেশি আন্দোলনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে এমনটিও দেখা যায় যে ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিনিয়োগের চাইতে বাংলার মানুষ জমিদারি অথবা জমিদারের অধীনে তালুকদারি বা জোতদারি কেনার দিকে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে যার ফলে অঞ্চলের মানুষ ব্যবসায়-বাণিজ্যেও পিছিয়ে পড়ে দুঃখজনক হলেও মজার বিষয় এই যে, ব্যবসায় লোকসানের ভয় আছে, জমিদারিতে কোনো লোকসান নেই; কৃষককে নিষ্পেষণ করে কর আদায় করতে পারলেই হলো হয়েছেও তাই; বাংলার কৃষকেরা ক্রমাগত ভূমিহীন দরিদ্র হয়ে পড়েছে

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হবার পর অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রম্নতি ছিল মধ্যস্বত্বভোগ প্রথার বিলুপ্তি কথা ছিল জমিদারদের মালিকানা থেকে রাষ্ট্র ভূমি অধিগ্রহণ করে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদের ফিরিয়ে দেবে এই উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করা হয় ১৯৬৩ সাল নাগাদ জমিদারদের কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয় তবে রাষ্ট্র এই অধিগ্রহণ করে জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমেই বলাই বাহুল্য যে, এই ক্ষতি পূরণের অর্থ ফের জনগণের কাছ থেকেই গিয়েছে অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলেও ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেবার প্রক্রিয়া সেই অর্থে সফল করা সম্ভব হয়নি

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত্ম ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক যে আইন রয়েছে, তার কোনটিই ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি যেমন- মধ্যস্বত্ব ভোগ বিলোপ হবার পরেও স্বাধীন দেশে আমরা প্রজাস্বত্ব বা টিনেন্সি শব্দটি ব্যবহার করে আইন প্রণয়ন করেছি যা প্রায় ৭০ বছর ধরে আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনায় মুখ্য আইন হিসেবে বলবৎ রয়েছে ছাড়াও ভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আলাদা আলাদা আইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুসংহত সুনির্দিষ্ট ভূমি আইন তাই প্রবল আকাঙ্ড়্গার বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার বিবর্তনের যে ইতিহাস তার মাঝেই এদেশের যাবতীয় ভূমি বিরোধ, আর্থসামাজিক অসমতা এবং সর্বোপরি সকল সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যার বীজ নিহিত তাই খসড়া ভূমি আইনের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি

সম্ভাবনা

ভূমি আইন, ২০২০ এই নামটিই বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ধারণায় এক উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কেননা, একটি আইনের নামকরণের মাধ্যমেই তার উদ্দেশ্য বা কর্মক্ষেত্র স্পষ্ট হয় আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও যখন অন্যান্য বিধানে অস্পষ্টতা ফুটে ওঠে, আইনটির নামকরণ তখন তার মূ বিষয়বস্তু বা তার মূ উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে ইতোপূর্বে ভূমিবিষয়ক মুখ্য আইন রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ অথবা অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪৯ প্রজাস্বত্বকে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করেছে ভূমি আইন, ২০২০ সেখানে প্রজাস্বত্ব্বের চাইতে ভূমির দিকে অধিক আলোকপাত করবে সেক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যার সময় ভূমি উন্নয়ন, ভূমি সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয় শুধু নামের কারণেই প্রাধান্য পাবে

আইনটির প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর অধীনে মধ্যস্বত্ব ভোগের প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে ফলে আইনটির উক্ত অংশ বলবৎ রাখার আর কোনো উপযোগিতা নেই উক্ত অংশ বাদ দিয়ে অন্যান্য অংশ সংশোধন হালনাগাদ করা প্রয়োজন একইসাথে ভূমিবিষয়ক যত আইন বলবত্ রয়েছে তা সুসংহত করাও এই আইনটির একটি উদ্দেশ্য হিসেবে প্রস্তাবনা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া আইনটির ২৭৩ ধারায় ভূমি বিষয়ে বর্তমানে বলবৎ ২২টি আইন রহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে তার মানে বর্তমানে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ২২টি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ আছে খসড়া আইনটিতে কৃষি অকৃষি জমি সুরক্ষা থেকে শুরম্ন করে সম্পত্তি অধিগ্রহণ হুকুম দখল, সিকসিত্ম-পয়সিত্ম, সায়রাত মহল, খাসজমি, অর্পিত সম্পত্তি এমনকি ওয়াকফ, দেবোত্তর সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের সম্পত্তিবিষয়ক বিধান সংবিধিবদ্ধ হয়েছে এর প্রতিটি বিষয়েই বর্তমানে রয়েছে আলাদা আলাদা আইন অর্থাত্ নতুন আইনটি নির্বাহী দেওয়ানি জটিলতা কমাতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম তবে বলে রাখা ভালো ভূমি আইনটি কেবল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সীমাবদ্ধ অর্থাত্, ভূমিহস্তান্তর বা ভূমিতে বিভিন্ন প্রকারের অধিকার তৈরি হওয়া এবং তা হস্তান্তর বিষয়ক আইন বিজ্ঞান এখনো সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ দ্বারা পরিচালিত হবে

আইনটিতে নতুন করে ভূমি জরিপের বিধান রাখা হয়েছে আইনের ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার ভূমি জরিপের আদেশ প্রদান করতে পারবে আদেশ প্রদানের দুই বত্সরের মধ্যে জরিপকৃত ভূমিসমূহের খতিয়ান বা রেকর্ড অব রাইট প্রস্তুত করতে হবে ছাড়াও নতুন ভূমি আইনে পরিবেশ প্রতিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে আইনটির একাদশ অধ্যায়ে বিশেষভাবে বনভূমি সংরক্ষণ বিষয়ক বিধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে বনভূমি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে একাদশ অধ্যায় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের বিধানের ক্ষেত্রেও পরিবেশ বিষয়ে আইনটির সচেতনতা পরিলক্ষিত হয় চা-বাগান বা রাবার বাগানের ভূমি সুরক্ষায় বিধান তো রয়েছেই, ব্যক্তিগত বনভূমি ব্যবহারেও আরোপিত হয়েছে বিধিনিষেধ ছাড়াও খসড়া আইনে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির অধিকার যেন খর্ব না হয় সে বিষয়ক আইনও হালনাগাদ করা হয়েছে

উৎকণ্ঠা

খসড়াভূমি আইনটির পঞ্চদশ অধ্যায়ে দেওয়ানি আদালতের ওপর চাপ কমাতে প্রত্যেক জেলায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা উলেস্নখ করা হয়েছে আইনটির ২৬৪ ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সহকারী ভূমি কমিশনার প্রমুখ সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা দ্বারা গঠিত হবে ভুল রেকর্ড, জবরদখল, সীমানা বিরোধ ইত্যাদি বিষয় ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করবে কিন্তু, নির্বাহী কর্মকর্তা দ্বারা গঠিত ট্রাইব্যুনালের এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করার মতো আইন বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বিশেস্নষণী দক্ষতা প্রজ্ঞার ঘাটতি থাকতে পারে, যা ন্যায়বিচারকে অনিশ্চিত করে ফেলবে ছাড়াও উক্ত ট্রাইব্যুনালকে এতটাই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যে, আইনটির ২৭৪ ধারা অনুযায়ী কোনো দেওয়ানি আদালত সংক্রান্ত্ম মামলার আরজি গ্রহণ করতে পারবে না এমনকি ট্রাইব্যুনালে নিষপত্তি হওয়ার পর ক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করতেও আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে না ২৬৫ ধারায় যে আপিলের বিধান রয়েছে, সেটিও করতে হবে কমিশনারের কাছে বাংলাদেশের সংবিধান ক্ষমতার বিভাজন ভারসাম্যের যে বিধান প্রতিষ্ঠিত করেছে, নির্বাহী বিভাগকে বিরোধ নিষ্পত্তির এহেন অরক্ষিত ক্ষমতা প্রদান, সেই ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে দেবে

এক্ষেত্রে বিতর্ক উঠতে পারে, শুধু ভুল রেকর্ড, জবর দখল ইত্যাদি বিষয়ই তো কেবল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হচ্ছে; মালিকানা বা বাঁটোয়ারা তো দেওয়ানি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে কিন্তু, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশে ভূমির সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন নিয়ামক জড়িত নির্বাহী বিভাগ স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে ভীষণভাবে উন্মুক্ত; বিচারবিভাগকে প্রভাবিত করা সেই তুলনায় দুঃসাধ্য এমনও হতে পারে, কোনো একটি বিরোধ স্থানীয় প্রভাবে পড়ে ট্রাইব্যুনালে আটকে আছে, এই কারণে আদালতেও যাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বস্তুত জবরদখল বাংলাদেশে একটি পরিচিত ঘটনা ট্রাইব্যুনালেই নিষ্পত্তি আপিল সম্পন্ন হলে পারিপার্শ্বিক প্রভাবে সংক্ষুব্ধ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে বিবাদী দুটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষ হতে পারে খোদ সরকার সেক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনাল নিজেই নিজের বিরোধ নিষ্পত্তি করবে ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতি অনুযায়ী, No one should be the judge of his own cause তাই খসড়া ভূমি আইনটির বিরোধ নিষ্পত্তির নিমিত্তে এমন অরক্ষিত ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে তুলে দেবার প্রসত্মাবনা আইনটির তাৎপর্য সম্ভাবনা ছাপিয়ে উত্কণ্ঠাই জাগাচ্ছে অধিক

পরিশিষ্ট

বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভূমিব্যবস্থা বা অব্যবস্থাপনার ইতিহাস দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়ে ভূমি ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত্ম গ্রহণের যে ত্রম্নটিগুলো ছিল তার দায় অঞ্চলের মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের অর্থনীতি রাজনীতিতেও ভূমি অন্যতম মুখ্য প্রভাবক তাই ভূমিসংক্রান্ত্ম সকল আইন সুসংহত করা এবং একটি সুস্থিত বিরোধবর্জিত ভূমি ব্যবস্থাপনাকাঠামো প্রতিষ্ঠা প্রবল আকাঙ্ড়্গিত সুষ্ঠু একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলে ভূমিবিষয়ক বিবাদও কমে আসবে; চাপ কমবে দেওয়ানি আদালতের তবে আদালতের চাপ কমাতে নির্বাহী বিভাগের হাতে অরক্ষিত ক্ষমতা তুলে দিলে তা ন্যায়সংগত হবে না বরং, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভারসাম্যের যে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি তা ক্ষুণ্ন হবে উৎকণ্ঠার জায়গাগুলো সংশোধিত হয়ে আকাঙ্ক্ষিত ভূমি আইন, ২০২০ জনমানুষের প্রত্যাশাগুলো পূরণে সফল হয়ে উঠুক এটিই এখন প্রত্যাশা

তথ্যসূত্র:

  1. ওয়েবসাইট: বাংলাদেশ আইন কমিশন - http://www.lc.gov.bd/
  2. Dr Naim Ahmed et al, ‘Proposed Bangladesh Land Act 2020: what legal experts say’ The Daily Star: Law & Our Rights (Dhaka, 15 September 2020)
  3. Madhav Gadgil, Ramachandra Guha, Equity & Ecology (first published 1995, Routledge 2005) 10 [2]
  4. GN Tanjina Hasnat et al, ‘Historical Evolution of Land Administration in Bangladesh’ [2018] IJIR 76 [Table 1]
  5. . এস এম মাসুম বিলস্নাহ, আইনের ভাব অভাব (প্রথম প্রকাশ ২০১৯, পলল ২০১৯) ১৪৬ []

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন