দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ও অলস তারল্যের জোয়ার দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে ব্যাংকারদের

হাছান আদনান

ব্যাংকে ফিরছে না বিনিয়োগকৃত অর্থ। এতে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে অনুৎপাদনশীল সম্পদ। এক বছর ধরে নতুন বিনিয়োগও প্রায় বন্ধ, যার প্রভাবে স্ফীত হয়ে উঠছে ব্যাংকের অলস তারল্যের আকারও। এমন পরিস্থিতিতে পোর্টফোলিও বড় হলেও দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকের ভিত।

মহামারীর আঘাতের আগেই দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত (স্ট্রেসড) চলতি বছরজুড়ে চলছে ঋণ পরিশোধে শিথিলতা। খেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ থাকায় গ্রাহকরাও অনেকটা নির্ভার। পরিস্থিতি যা তাতে ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতার ওপর দেয়া স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়তে পারে আরো ছয় মাস। সব মিলিয়ে আগামী বছর ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ব্যাংকারদের।

দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে ঋণ আদায়ের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা হতাশাই বাড়াচ্ছে। ব্যাংকাররা বলছেন, মহামারীর আগেই ব্যাংক খাতের প্রায় ২৫ শতাংশ ঋণ দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। খেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ থাকায় ভালো ব্যবসা করছেন, এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রেখেছেন। শ্রেণীকৃত ঋণের মেয়াদ গণনা শুরু হলে খেলাপি হওয়া থেকে গ্রাহকদের বাঁচাতে ঢালাওভাবে পুনঃতফসিল করতে হবে। ফলে আগামী বছর দেশের ব্যাংক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ৪০ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ থাকায় বাড়বে অলস তারল্য। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষেই অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে লাখ ৬৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পাশাপাশি সীমাতিরিক্ত অলস তারল্যও ব্যাংক খাতের বিপদ বাড়াবে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে না পারলে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য তা সংকট তৈরি করবে বলে মনে করছেন তারা।

ধেয়ে আসা দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোকে এখনই নিজ নিজ ঋণ পোর্টফোলিওর ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা দরকার বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মহামারীর আঘাতের আগেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল লাখ কোটি টাকার বেশি। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণও লাখ কোটি টাকার কম নয়। এর বাইরে আছে অর্ধলক্ষ কোটি টাকার অবলোপনকৃত ঋণ। এখন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকরা স্বাধীনতা ভোগ করছেন। ইচ্ছে হলে ঋণের কিস্তি দিচ্ছেন, না হলে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মুহূর্তে ব্যাংকারদের প্রধান দায়িত্ব হলো গ্রাহক ধরে ধরে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা। কোন গ্রাহক টাকা দিচ্ছেন, কে দিচ্ছেন না, করোনা পরিস্থিতি শেষ হলে ওই গ্রাহকের পরিস্থিতি কী হবেএগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান।

আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ আড়াল করতে ব্যস্ত থাকেন ব্যাংকাররা। মূলত পুনঃতফসিল অবলোপনের মাধ্যমে আড়াল করা হয় খেলাপি ঋণ। যদিও পুনঃতফসিল করা ঋণ পরবর্তী সময়েও উঠে আসছে খেলাপির তালিকায়। শুধু ২০১৯ সালে ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে, যা এক বছরে সর্বোচ্চ পরিমাণে পুনঃতফসিলের রেকর্ড। খেলাপি, পুনঃতফসিল পুনর্গঠনকৃত ঋণকে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ৮৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ২০১৯ সালে পুনঃতফসিল করা অর্ধলক্ষ কোটি টাকা যুক্ত হওয়ায় বছর শেষে শুধু দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ যুক্ত হলে ব্যাংক খাতের বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। সে হিসাবে করোনাভাইরাসের আঘাত আসার আগেই ব্যাংকঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি ছিল বিপদগ্রস্ত।

ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছেন না বলে জানান ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন। তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও ভালো ব্যবসা করছেন, এমন গ্রাহকরা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এতে প্রতিনিয়ত সুদ যুক্ত হয়ে গ্রাহকদের ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে এসব গ্রাহককে প্রণোদনার অর্থও ঋণ হিসেবে দিতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের বড় অংশই মনে করছেন, প্রণোদনার অর্থ ফেরত দিতে হবে না। যদিও নির্ধারিত মেয়াদ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে প্রণোদনার অর্থ কেটে নেবে। পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং করা অত্যন্ত কঠিন।

ফারুক মঈনউদ্দীনের ভাষ্য, ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আইন নীতি প্রণীত হচ্ছে। অবস্থায় আগামী বছর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা- দেখার বিষয়।

করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ যে অস্বাভাবিক হারে বাড়বে, তা নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশ ব্যাংকও। এরই মধ্যে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলোর নিয়মিত থাকা ঋণের বিপরীতেও চলতি বছর শেষে শতাংশ হারে অতিরিক্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বিশেষ সঞ্চিতি স্থানান্তর করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোকে চলতি বছরের পরিচালন মুনাফা থেকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়মিত মেয়াদি ঋণগুলোকেও আগামী বছর পুনঃতফসিল করে দিতে হতে পারে বলে মনে করেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, বাধ্যবাধকতা না থাকায় ভালো ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছেন না। খেলাপি ঋণের সময় গণনা শুরু হলে অনেকেই যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অবস্থায় গ্রাহকদের মেয়াদি ঋণগুলো পুনঃতফসিল করে দেয়ার সুযোগ দিতে হতে পারে। কারণ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমেই বিধিনিষেধ আরোপিত হবে।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নতুন কোনো বিনিয়োগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখছি না। এজন্য আমরা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছি। নিজেদের পরীক্ষিত গ্রাহকরা কোনো ঋণ প্রস্তাব নিয়ে এলে তা যাচাই-বাছাই করে কিছু টাকা দিচ্ছি।

এক বছর আগেও তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছিল দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তবে মহামারীর প্রাদুর্ভাবে পরিস্থিতি বর্তমানে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। এখন রীতিমতো অলস তারল্যের জোয়ার বইছে ব্যাংকগুলোয়।

এক বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিতে খরা ছিল তারল্য সংকটের কারণে। এখন ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোয়ার বইলেও ঋণের চাহিদা নেই। আবার নতুন বিনিয়োগের জন্য আবেদন এলেও বাড়তি সতর্কতার কারণে ব্যাংকাররা মুহূর্তে ঋণ দিতে চাইছেন না। ফলে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ৬১ শতাংশ। যদিও সময়ে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বেসরকারি খাতে অর্ধলক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে। করোনায় বড় ধাক্কা খাওয়া দেশের আমদানি খাত এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। যদিও অক্টোবর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে লাখ ৬৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অলস তারল্য।

অতিরিক্ত তারল্যের চাপ সামলাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। এক বছর আগেও যেখানে কোনো কোনো ব্যাংক শতাংশের বেশি সুদে তিন-ছয় মাস মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করেছে, এখন তা - শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তার পরও অতিরিক্ত তারল্যের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাংকারদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন। তারা বলেন, ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার শতাংশে নেমে এসেছে। পরিস্থিতি যা তাতে বিনিয়োগ বা ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে না পারলে অচিরেই ব্যাংক আমানতের সুদহার - শতাংশে নেমে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন