উজ্জ্বল ভাবমূর্তি শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের বড় অর্জন

এম শহীদুল ইসলাম দুই বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী পদে। দীর্ঘ ৩৬ বছর দেশের শীর্ষস্থানীয় চারটি ব্যাংকের বিভিন্ন পদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি, শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে নিজের কাজের অভিজ্ঞতাসহ দেশের ব্যাংকিং খাতের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি ব্যাংকার কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

১৯ পেরিয়ে ২০ বছরে পা রাখল শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক। দুই দশকের যাত্রায় ব্যাংকের অর্জন কী?

দেশের উচ্চশিক্ষিত, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত একঝাঁক ব্যবসায়ীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ২০০১ সালের ১০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ পথযাত্রায় ব্যাংকটি অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। বিভিন্ন মানদণ্ডে ব্যাংকের আর্থিক ভিত অত্যন্ত সুদৃঢ়। আর্থিকভাবে শক্তিশালী দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে সামনের সারিতেই শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান। যাদের উদ্যোগ কর্মে ব্যাংকটি আজকের অবস্থানে এসেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের ২১ হাজার ৬০৮ কোটি টাকার আমানত। আমানত থেকে আমরা শরিয়াহ্র বিধান মেনে ২০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। সব মিলিয়ে এটি এখন প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সম্পদের একটি ব্যাংক।

দেশজুড়ে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ১৩২টি শাখা রয়েছে। এছাড়া ৩৭টি এজেন্ট আউটলেট, দুটি উপ-শাখা ১১০টি এটিএম বুথের মাধ্যমে আমরা গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছি। পোশাক শিল্প, শিল্প, বাণিজ্য, এসএমই, রিটেইল, আমদানি, রফতানিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক দেশের অর্থনীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আমরা দুস্থ সহায়-সম্বলহীন মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, ঘূর্ণিঝড় বন্যাকবলিত দুর্গত এলাকায় খাদ্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, মেধাবী দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানসহ সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে ব্যাংক শক্তিশালী রেটিং পেয়েছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশীয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আমাদের পুরস্কৃতও করছে। শতভাগ শরিয়াহ্ কমপ্লায়েন্ট ব্যাংক হিসেবে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এটিই ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অর্জন। 

পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের সবকটি সূচকে উন্নতি হয়েছে। উন্নতির মন্ত্র কী?

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি কর্মীদের একসঙ্গে উজ্জীবিত করে তোলার কর্মসূচি নিয়েছিলাম। আগে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকদের সম্মেলন হতো। কিন্তু ২০১৮ সালের শুরু থেকে আমি প্রচলিত ধারার সম্মেলন আয়োজন থেকে বেরিয়ে এসেছি। গত দুই বছরে আমরা ব্যাংকের যেসব সম্মেলন করেছি, তাতে আগের দিন যোগদান করেছে এমন কর্মীরাও উপস্থিত ছিল। যেসব কর্মী কোনোদিনই ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিকে চোখে দেখেনি, তারা সম্মেলনে এসে অনুপ্রাণিত হয়েছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্মীদের নিয়ে সম্মেলন করেছি। এর ফলে প্রতিটি কর্মী উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সম্মেলন থেকে নিজেদের কাজ দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। ব্যাংকের সব কর্মী একমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ায় গত দুই বছরে ব্যাংকের প্রতিটি সূচকে বড় উন্নতি হয়।

২০১৭ সালে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৫৮ কোটি টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯ সালে ব্যাংক ৬১৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে। ২০১৭ সালে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে তা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। 

শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে গত দুই বছরে কোন অর্জনটিকে আপনি সবচেয়ে বড় বলে মনে করেন?

২০১৮ ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে ছিল তীব্র তারল্য সংকট। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকেও ছিল। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে যোগদানের পর অনেক সময়ই আমাদের কলমানি বাজারের পাশাপাশি অন্য ব্যাংক থেকে আমানত ধার নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন তারল্য পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে অন্য ব্যাংককে আমানত ধার দিচ্ছে। আগে ব্যাংকের আমানতের বড় অংশই ছিল করপোরেট। কিন্তু গত দুই বছরে আমরা করপোরেট আমানত কমিয়ে রিটেইল আমানত বাড়িয়েছি। ২০১৭ সালে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ছিল দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বরে তা দশমিক ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারল্যের সংকটের সময়ও কস্ট অব ফান্ড কমিয়ে আনা ছিল চ্যালেঞ্জের। কর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চ্যালেঞ্জে আমি বিজয়ী হতে পেরেছি। তবে এখনো শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের মোট আমানতের ২৬ শতাংশ স্কিম। এসব আমানতের মুনাফার হার সাড়ে শতাংশের বেশি। এগুলো কমিয়ে আনা হলে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড আরো কমে আসবে। 

শহর না গ্রাম, ব্যাংকের সম্প্রসারণের জন্য কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন?

দেশে ব্যাংকের সেবা নগরকেন্দ্রিক ছিল। ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাংকিংয়ের সুফল পৌঁছেনি। গত দুই বছর ধরেই আমরা গ্রামাঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকের সম্প্রসারণ করছি। ২০১৮ ২০১৯ সালে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ১৯টি শাখা খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিই খোলা হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। পাশাপাশি আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছি। আগামী দিনগুলোতে আমরা গ্রামীণ অর্থনীতি জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে চাই। বড় ঋণ না দিয়ে এসএমই রিটেইলে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে।

আধুনিক প্রযুক্তি এখন ব্যাংকিং সেবার অন্যতম অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিস্থিতি কী?

শুরু থেকেই আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের বিকাশ হয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আমরা এর সুফল পেয়েছি। আমাদের গ্রাহকরা ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছেন। আমাদের রয়েছে পরিপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যাংকিং মোবাইল অ্যাপস ভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা। এর মাধ্যমে গ্রাহকরা বাংলাদেশের যে কোনো তফসিল ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর, বিল পরিশোধ, কেনা-কাটার পেমেন্ট, ব্যালান্স স্টেটমেন্ট দেখা, চেক রিকুইজিশন, চেক স্টপ পেমেন্টসহ ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা খুব সহজ নিরাপদে করতে পারছেন। তার পরও আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আরো বেশি আধুনিক যুগোপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা ডিজিটাল অন-বোর্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছি, যার মাধ্যমে একজন গ্রাহক খুব সহজেই ঘরে বসে নিজেই নিজের ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন। দ্রুত সেবা নিশ্চিতের জন্য মিসড কল অ্যালার্ট গ্রাহকদের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগের জন্য ফেসবুক পেজ চালু করা হয়েছে। এছাড়া গ্রাহক সেবা দ্রুত, নিরাপদ আধুনিক করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত অপারেশনাল কার্যক্রম মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং যুগোপযোগী প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। 

শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক, কর্মী শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?

সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠার দুই দশকে পদার্পণ যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় অর্জন। আগামী বছর আমাদের ব্যাংক দুই দশক পূর্ণ করবে। দুটি বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি সে পরিকল্পনা সফল হতে দেয়নি। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের দীর্ঘ পথচলার প্রত্যেকটি সঙ্গীকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। চলমান মহামারীতে আমাদের বহু কর্মী করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন এখনো হচ্ছেন। তার পরও একদিনের জন্যও আমাদের কর্মীরা সেবাদান থেকে বিচ্যুত হননি। কর্মীদের ত্যাগের ফলেই মহামারীর মধ্যেও ব্যাংকের সব কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলেছে। এরই মধ্যে আমরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থের বেশির ভাগ বিতরণ করেছি। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক দেশবাসীর প্রতি আমার আহ্বান হলো, আমাদের কাছে থাকা আপনাদের প্রতিটি অর্থই নিরাপদ। আপনাদের অর্থের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন