সড়ক দুর্ঘটনা কমছেই না ৩ জেলায় নিহত ১৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির টানা ৬৬ দিন গণপরিবহন বন্ধ ছিল। সাধারণ ছুটির পর এক মাসেরও বেশি সময় সীমিত পরিসরে চলেছে যানবাহন। তার পরও থেমে থাকেনি সড়ক দুর্ঘটনা। এরপর পুরোদমে যানচলাচল শুরু হলে আরো বেড়ে যায় সড়কে প্রাণহানি। গতকালও তিন জেলায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন।

যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের আট মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৮৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে গত নভেম্বরেও দেশে সড়ক-মহাসড়কে ৪৪৩টি দুর্ঘটনায় ৪৮৬ জন নিহত ও ৭৪১ জন আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। দুর্ঘটনা থেমে নেই চলতি মাসেও। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে গতকাল ১৫ জন। 

বণিক বার্তার প্রতিনিধিরা জানান, গতকাল মানিকগঞ্জে সাতজন, টাঙ্গাইলে ছয় ও বগুড়ায় দুজন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। এর মধ্যে মানিকগঞ্জে বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ছয়জনসহ মোট সাতজন নিহত হন। বেলা আড়াইটার দিকে মানিকগঞ্জ-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়কের দৌলতপুর উপজেলার মুলকান্দি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন হরেকৃষ্ণ বাদ্যকার, তার ছেলে গোবিন্দ বাদ্যকার, পুত্রবধূ ববিতা রানী, নাতনি রাধেরানী, ভাইয়ের স্ত্রী খুশী রানি ও ভাতিজা রায় প্রকাশ এবং অটোরিকশাচালক জামাল শেখ।

সাতজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, দৌলতপুর থানায় মরদেহ রাখা হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি জব্দ করা গেলেও চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছেন। 

এদিকে গতকাল সকালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার কুর্ণী এলাকায় সবজিবোঝাই ট্রাকের ধাক্কায় বাসের ছয় যাত্রী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছে পুলিশ। তারা হলেন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জয়নাল হোসেনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম, পারভেজ আলীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম ও শানেরহাট গ্রামের রতন মিয়ার ছেলে ও ট্রাকের হেলপার চুন্নু মিয়া।

মির্জাপুর থানার ওসি সায়েদুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গতকাল সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কুর্ণী এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় সবজিবোঝাই একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকা বাসে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই এক নারীসহ বাসের চার যাত্রী নিহত হন। আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে নেয়ার পর আরো দুজন মারা যান। 

গতকাল বগুড়া জেলায়ও পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ দুজন নিহত হয়েছেন। বগুড়ার কাহালু থানার ওসি জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, গতকাল সকাল ৯টার দিকে উপজেলার বিবিরপুকুর এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় রিপন আহমেদ নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। তিনি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার বড় জামালপুর গ্রামের লুত্ফর রহমানের ছেলে।

নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্ক কাটিয়ে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে গাড়ির সংখ্যা যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় হতাহত মানুষের সংখ্যাও। সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, মানুষের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমছে না বলে জানিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক তৈরি, পরিবহন শ্রমিকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, গুণগত মহাসড়ক নির্মাণসহ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর সুষ্ঠু প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছে তারা।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতি বছর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনসহ নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মতো সংগঠনগুলোও দুর্ঘটনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এসব সংগঠনের হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর হিসাবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রকৃত মৃত্যুর পরিমাণ এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ২৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৮৬১ জনের। আহত হয়েছেন আরো ৪ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন ফেব্রুয়ারিতে। ওই মাসে ৩৮৭টি দুর্ঘটনায় ৪৬১ জন নিহত ও ৯৪৮ জন আহত হন। আর জানুয়ারিতে ৩৪০ দুর্ঘটনায় মারা যান ৪৪৫ জন। এছাড়া মার্চে ৪২৭ জন, এপ্রিলে ১১৯টি দুর্ঘটনায় ১৩৮ জন, মে মাসে ২১৩টি দুর্ঘটনায় ২৯২ জন, জুনে ২৯৭টি দুর্ঘটনায় ৩৬১ জন, জুলাইয়ে ২৯৩টি দুর্ঘটনায় ৩৫৬ জন, আগস্টে ৩০২টি দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত হয়েছেন। 

দেশে বেড়ে চলা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে প্রকৌশলগত ত্রুটি। এ কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। কঠোর আইন করেও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে না, যদি না সড়কের প্রকৌশলগত ত্রুটি দূর করা হয়। দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে ভিন্ন গতির যানবাহন একই মহসড়কে চলাচল। বিশেষ করে অধিকাংশ মহাসড়কেই সার্ভিস লেন নেই। ফলে স্থানীয় যানবাহন মূল সড়কে উঠে দুর্ঘটনার কারণে পরিণত হয়। এছাড়াও মহাসড়কগুলোর অধিকাংশ জায়গাতেই সড়ক বিভাজক না থাকায় মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনাগুলো ঘটছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন