বড় ঋণ নিয়েই বেশি আতঙ্ক ব্যাংকারদের

হাছান আদনান

করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে বছরব্যাপী ছাড় চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়ে ব্যাংকগুলো সম্পর্কের ভিত্তিতে বিভিন্ন কৌশলে সিএসএমই, কৃষি, রিটেইল, ক্রেডিট কার্ডসহ ছোট ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা আদায় করলেও বড়দের কাছ থেকে আদায় পরিস্থিতি খুবই নাজুক। ডিসেম্বর শেষে কিস্তি পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া ছাড় উঠে গেলে তখন বড়দের কাছ থেকে কীভাবে ঋণ আদায় করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার একটি সংস্কৃতি চালু হয়ে গিয়েছিল। এখন করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ এ সংস্কৃতিকে স্থায়ী রূপ দেয়ার দিকেই এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া ছাড়কে বড় ঋণগ্রহীতারা মহাসুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। ছোট ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে কৌশলে কিস্তি আদায় করা সম্ভব হলেও বড়রা টাকা দিচ্ছে না। উল্টো কিস্তি না দিয়ে তারা ব্যাংক থেকে প্রণোদনার অর্থ বের করে নিচ্ছেন।

ব্যাংকারদের অভিযোগের সত্যতা মিলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে করোনাভাইরাসের সূচনাকাল তথা জানুয়ারি থেকে মার্চ—এ তিন মাসে বড় শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় কমেছে ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অথচ একই সময়ে মাঝারি শিল্পের ঋণ আদায় ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ছোট ও কুটির শিল্পের ঋণ আদায় ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়েছিল। এপ্রিল থেকে জুন—এ তিন মাসে বৃহৎ শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় কমেছে ৫৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। করোনাভাইরাস সৃষ্ট অচলাবস্থার এ সময়েও বড়দের তুলনায় মাঝারি ও ছোটরা ব্যাংকঋণের কিস্তি বেশি পরিশোধ করেছে। এ তিন মাসে মাঝারি শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় কমেছিল ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর ছোট ও কুটির শিল্পের মেয়াদি ঋণ আদায় ৪৪ দশমিক ১৮ শতাংশ কমেছিল। বড়দের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের দীনতা এখনো চলছে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাহকদের ৩০-৩২ শতাংশ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন। বাকি ৭০ শতাংশের কাছ থেকেই টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছাড়ের কারণে ব্যাংকাররা গ্রাহকদের ওপর চাপ দিতে পারছেন না। ঋণ পরিশোধ না করার এ সুযোগ গ্রাহকদের অভ্যাসে পরিবর্তন আনছে কিনা, সেটি খুঁজতে হবে। 

মাসরুর আরেফিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছে। এ অবস্থায় জানুয়ারিতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে ভয়ে আছি। জানুয়ারিতে গিয়ে যদি আবারো ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতার সময় বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হবে। একদিকে ব্যাংকের কৃত্রিম মুনাফা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের বড় অংকের ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

চলতি বছরের জুন শেষে দেশের বৃহৎ শিল্পের মেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। বৃহৎ শিল্পের তুলনায় মাঝারি শিল্পের মেয়াদি ঋণ বহুগুণ কম। জুন শেষে মাঝারি শিল্পে ঋণের স্থিতি ছিল ৩৬ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। একই সময়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ হাজার ৭১২ কোটি টাকা ছিল মেয়াদি ঋণের স্থিতি। বৃহৎ শিল্পের মেয়াদি ঋণ ছাড়াও ট্রেডিং, আমদানি ও রফতানি খাত, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, সেবা খাতসহ দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের সিংহভাগ বৃহৎ শিল্প বা বড় গ্রাহকদের সঙ্গে যুক্ত। এ অবস্থায় বড় শিল্পের ঋণ আদায় পরিস্থিতিই সবচেয়ে বেশি খারাপ হওয়ায় ব্যাংকারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পরে দুই দফায় বাড়িয়ে এ প্যাকেজের আকার উন্নীত করা হয় ৪০ হাজার কোটিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, নভেম্বরের মধ্যেই বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের এ প্যাকেজের ৯৫ শতাংশ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। যদিও সিএসএমই খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে ব্যাংকগুলো। আবার কৃষিসহ ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্যাকেজের অর্ধেকও ব্যাংকগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় চলতি মূলধন পাওয়ায় বড় গ্রাহকদের ঋণের পরিমাণ আরো বেড়েছে।

দেশের ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি তিন মাস পর ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনটির জুন সংখ্যায় ব্যাংকগুলোর স্ট্রেস টেস্টিং বা ঝুঁকি সক্ষমতা বিষয়ে বলা হয়, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে পাঁচটি ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা হারাবে। একইভাবে খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ বাড়লে মূলধন সক্ষমতা হারাবে ৩০টি ব্যাংক। আর খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৬টি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে।

বড় গ্রাহকদের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়ে স্ট্রেস টেস্টিং প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর শীর্ষ তিনজন গ্রাহক খেলাপি হলে ২৩টি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে। অর্থাৎ শীর্ষ তিনজন গ্রাহকের ভাগ্যের সঙ্গে ২৩টি ব্যাংকের ভাগ্যও অনেকটা ঝুলে গেছে। আর শীর্ষ সাত গ্রাহক খেলাপি হলে প্রয়োজনীয় মূলধন সক্ষমতা হারাবে ৩৫টি ব্যাংক। শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপি হলে ৩৮টি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে।

এ অবস্থায় জানুয়ারিতে খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনা শুরু হলে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বলেন, জানুয়ারি থেকে ব্যাংকারদের জন্য চ্যালেঞ্জিং টাইম শুরু হবে। গ্রাহকরা টাকা না দিলে খেলাপি ঋণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ আরো বাড়ানো হলে সংকটের ঢেউ হয়তো কিছুটা বিলম্বিত হবে। তবে ব্যাংকগুলোর জন্য বড় ধরনের বিপদ আসছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঢালাও সিদ্ধান্ত না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কিছু বিষয় ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়াই মঙ্গল। শিল্প খাত ও গ্রাহক বেঁধে ব্যাংকগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য সরেজমিনে গ্রাহকদের পরিস্থিতি দেখা দরকার। আর ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতা বাড়ালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরও চাপ কমবে।

করোনাভাইরাসের পাশাপাশি বন্যায় দেশের কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তার পরও বড় গ্রাহকদের তুলনায় কৃষকদের ব্যাংকঋণ পরিশোধের হার অনেক বেশি। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কৃষকদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমেছে ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তার মানে কৃষকরা বড় শিল্পের তুলনায় অনেক বেশি হারে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করেছেন।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, কৃষি ব্যাংক থেকে যেসব শিল্পপতিকে ঋণ দেয়া হয়েছে, করোনাকালে তারা ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেননি। কিন্তু কৃষকরা আগের তুলনায় অনেক বেশি ঋণ পরিশোধ করেছেন। এর ফলে কৃষি ব্যাংকের ঋণ আদায় অনেক বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন