জিডিপি, পিপিপি ও অর্থখাতের ‘নক্ষত্রমণ্ডলী’ সমাচার

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রকাশিত হার বা সূচক নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও বক্তব্যে এসব সূচকের বাস্তবতা ও সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান হার এবং করোনাকালেও প্রাপ্ত এই হারের ‘স্বস্তিদায়ক’ সূচকের সহিত মানুষের যাপিত জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রাম মেলানো যাচ্ছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঘোষিত তথ্য ও অন্যান্য সূচক অনুযায়ী অর্থনীতির সুস্বাস্থ্য দেশের মানুষের জন্য কার্যকর কল্যাণে আসছে কিনা- সেটি বিবেচনার দাবি রাখে।

দৃশ্যতঃ কম সংখ্যক মানুষই এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচকের সুবিধাভোগী হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবেই অর্থ সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে শুধুমাত্র একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে ও বৈষম্যের তীব্রতা সমাজে প্রকটভাবে বাড়ছে।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা পেতে অর্থের সংস্থান করা অসাধ্য হয়ে পড়েছে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে চলমান উন্নয়ন কৌশল, প্রচারিত উন্নয়ন ধারণা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অর্থখাতের চিত্রিত অগ্রসরতায় সাধারণ মানুষ আসলেই ন্যায্য সুবিধাভোগী অংশীজন হতে পারছে কিনা!

পুঁজি অর্থব্যবস্থার সমাজে মানুষের সম্পদ ও অর্থের সাম্য থাকবে- এটা নিশ্চয়ই কেউ আশা করে না। তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হলে সাধারণ মানুষের কাছে ন্যায়সঙ্গতভাবে ন্যূনতম সম্পদ ও অর্থের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয় এবং বৈষম্য কমে আসে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না এবং বৈষম্য কমানোর কার্যকরী পদক্ষেপও দৃশ্যমান নয়। ফলে সাধারণভাবে দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটেনি।

অর্থখাতের জন্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের মানুষের Purchasing Power Parity (পিপিপি) বা ক্রয় ক্ষমতার সমতার বাস্তবতা বেশ গুরুত্ব বহন করে। দেশভেদে, মুদ্রার মানভেদে, পণের অভ্যন্তরীণ মূল্যভেদে মানুষের হাতে অর্থের সংস্থানের পরিমাণগত পার্থক্য অনুযায়ী পিপিপির বিষয়টি বিবেচিত হয়।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির শতাংশের হার বা পার ক্যাপিটা জিডিপির পরিমাণ দ্বারা কোনো দেশের সকল মানুষের আর্থিক সঙ্গতি ও ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা নিরূপিত হয় না। বাংলাদেশের মতো তীব্র বৈষম্যপীড়িত সমাজে এসকল সূচকের ইতিবাচক প্রতিফলন অনুপস্থিত। ফলে এখানে পিপিপি পরিস্থিতি ভয়ানকভাবে নাজুক। জিডিপি সমৃদ্ধকরণে সাধারণ মানুষের সার্বিক অংশগ্রহণ ও অবদান আছে। কিন্তু পিপিপির ক্ষেত্রে, ভোক্তা হিসেবে, আর্থিক সক্ষমতার জায়গায় অধিকাংশ মানুষ সুফলভোগী নয়। দেশের বিরাজমান বৈষম্যপরিস্থিতি নিয়ে বহুপুর্বেই প্রবীণ ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছিলেন, “...আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুললাম, যা উত্তরাধিকার সূত্রে যে সমাজটি আমরা পেয়েছিলাম তার চেয়েও অধিক বৈষম্যপীড়িত।...গত ৪০ বছরে উন্নয়ন কৌশলগুলো অন্যায্যতা ও তীব্র বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে যা বাংলাদেশে দুটি সমাজ সৃষ্টি করেছে।...আমরা ভর্তুকি দিচ্ছি, করে ছাড় দিচ্ছি, ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিচ্ছি— এসব কারণে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে...”।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম বর্ষ পূর্তিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন —‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’

কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পথে পরিচালিত হয়নি, হচ্ছে না। আমাদের ব্যবস্থাটি কেবলই একটি শ্রেণীকে ধনী ও ধনীতর বানাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনৈতিক সাচ্ছন্দ্য অধরাই থেকে যাচ্ছে।

আমাদের দৃশ্য-অদৃশ্য লুটেরা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের টাকা লোপাটকারী, ঋণখেলাপি, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে দেশের অর্থসম্পদ করায়ত্ত করে নেয়ার গুরুতর ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েকবছরে অর্থসম্পদ লুটের ক্ষেত্রে একটা ‘নক্ষত্রমণ্ডলী’ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষেত্রের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট, ডেসটিনি, পি কে হালদার, সম্রাট, এনু-রূপম, শাহেদ, জেকেজি, ড্রাইভার মালেক, মিঠু গং, ফরিদপুরের রুবেলবর্গ প্রভৃতি ঘটনা দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এগুলোর সঙ্গে সম্প্রতি নতুন করে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের জনৈক আবদুল আলিম চৌধুরী কর্তৃক ব্যাংকের টাকায় বিদেশে সম্পদ গড়ার সংবাদ ও ‘গোল্ডেন মনির’কে আবিষ্কারের মতো ঘটনা। মানুষের ধারণা এরূপ বহু অনু্দ্ঘাটিত ও অপ্রকাশিত লুটপাট অন্তরালে রয়ে গেছে এবং দুর্নীতি-লুটপাটের ফলেই মানুষ কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সক্ষমতার জায়গায় যেতে পারছে না, উন্নয়নের সুফলভোগী হতে পারছে না।

এ পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল হোসেন বলেন, ‘উন্নয়ন চাইলে লুণ্ঠন বন্ধ করতে হবে’।

ব্যাংকের টাকা লুটকারী, ঋণখেলাপি, টাকা পাচারকারী, বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি অসৎপথে অর্থসম্পদ গড়ে তোলা বিশেষ সুবিধা নেয়া প্রভাবশালী একটি ‘এলিট’ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে দেশে। এদেরকে নিবারণ করা যাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে লুটপাট ও দুর্নীতির ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ও সমাজে বৈষম্য বাড়ার গ্রাফ কেবলই উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এরূপ আলোচনার মধ্যে দেশের বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘...এমন কোনো সমাজ নেই, যেখানে বৈষম্য নেই’।

এ প্রসঙ্গে মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস স্মরণীয়, ‘যুক্তি সবসময় হাজির করা যায়, তবে সেটি সবসময় যুক্তিযুক্ত হয় না’।

চট্টগ্রামের আবদুল আলীম চৌধুরীর ঘটনাটি বণিক বার্তা প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার লুটপাটের শিকার বা অর্থের যোগানদাতা ব্যাংকের একটি ‘ব্যাংক এশিয়া’। এরূপ প্রতারণা ও কারসাজি নিয়ে ব্যাংকটির এমডির বক্তব্য, ‘এসব প্রতারণার ডিজাইন করা থাকে’।

তিনি অবশ্য এমন ডিজাইনের ফাউন্ডেশন, পিলার, ডালপালাসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ নিয়ে কিছু বলেননি।

ঋণের নামে অর্থলোপাটের ঘটনায় জনতা ব্যাংকের নাম অগ্রভাগে। ১ ডিসেম্বর ২০২০-এর ভোরের কাগজ পত্রিকায় ব্যাংকটির এমডি আবদুস সালাম আজাদের ভাষ্য, ‘যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, সেজন্য আমি একা দায়ী নই, অনেকেই দায়ী। এ ঘটনায় আরো অনেকের নাম আসা উচিত’।

সংশ্লিষ্টদের ‘যুক্তিসদৃশ’ সাফাই বক্তব্যেই দেখা যাচ্ছে, লুটপাট সংঘবদ্ধভাবে সুনিপুণ নকশা করে করা হচ্ছে। অংশীজনও বড় মানুষেরা। ভুগছে সাধারণ মানুষ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি-উন্নয়ন তত্ত্ব কাজে আসছে না। এখানে পিপিপি বা ক্রয়ক্ষমতার সমতার সূত্র অর্থহীন। দানবশ্রেণীর কথিত এলিটবর্গ নক্ষত্রেরা সবকিছুর সুবিধাভোগী। বৈষম্য কমাতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ করে দেশের মানুষকে সত্যিকারের উন্নয়ন অংশীজন করতে হবে, দেশের স্বার্থেই।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন