২৭ নভেম্বর জীবনমঞ্চ ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের নন্দিত অভিনেতা, নির্দেশক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে অদৃশ্য জীবাণু ঘাতক করোনাভাইরাসের কাছে পরাজিত হন প্রতিবাদী নূরলদীন। গ্যালিলিও, ম্যাকবেথ কিংবা দেওয়ান গাজী চরিত্রে মঞ্চে আর দেখা যাবে না তাকে। আলী যাকেরের প্রয়াণে তার সমসাময়িক ও তরুণ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বলছেন তার শূন্যস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। স্বনামধন্য অভিনেতা আলী যাকেরের সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে মঞ্চ ও টিভি নাটকে কাজ করেছেন দেশের অনেক খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পীরা। তাদের মধ্যে অন্যতম বরেণ্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার। মঞ্চে ম্যাকবেথ আলী যাকেরের সঙ্গে লেডি ম্যাকবেথ ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়শৈলী মঞ্চপ্রেমীদের ভোলার কথা নয়। সহশিল্পী, সহযোদ্ধার চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভারাক্রান্ত ফেরদৌসী মজুমদার। তবুও ফোন করামাত্রই সহযোদ্ধা সম্পর্কে কিছু না বলে থাকতে পারলেন না। অল্প কথায় মেলে ধরলেন পুরনো স্মৃতির ঝাঁপি। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
১৯৭০ সালের আগে থেকেই বেশকিছু নাটকে একসঙ্গে অভিনয় করেছি আমরা। ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’ মঞ্চনাটক করেছি। তার সঙ্গে মঞ্চে প্রথম অভিনয় করি ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে। তিনি ছিলেন ম্যাকবেথ। আর আমি লেডি ম্যাকবেথ। এটি যৌথ প্রযোজনার মঞ্চনাটক ছিল। আলী যাকের ছিলেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের। আমি থিয়েটার দলের। দুই নাট্যসংগঠনের কয়েকজন সদস্য মিলে নাটকটি করি। এটি পরিচালনা করেছিলেন ব্রিটিশ পরিচালক ক্রিস্টোফার সানফোর্ড। নাটকটি বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু আমাদের টিম ওয়ার্ক খুব ভালো ছিল। এরপর ‘টেমপেস্ট’ মঞ্চনাটকটি করি। এর পরিচালক ছিলেন একজন নারী। নাম ডেবোরা ওয়ার্নার। খুব ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমাদের। আলী যাকের আমার সহ-অভিনেতা। সহযোদ্ধা হিসেবে তাকে আমি পছন্দ করতাম। খুব সরল ছিলেন। যেমনি বড়সর ছিলেন তেমনি তার হাসিটাও ছিল সরল। কথাবার্তাও অনেক সরল। অনেক জ্ঞানী ছিলেন। অভিনয় খুব ভালোবাসতেন। শেষদিকে তো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। তখন মাঝে মাঝে তাকে দেখতে যেতাম। দেখতে গেলে খুব খুশি হতেন। সবশেষ তার সঙ্গে ‘লাভ লেটার’ নামে একটি আমেরিকান নাটক করার কথা ছিল। সেটা শুধু নাটক পাঠ করা। আমি ও আলী যাকের কেবল এই দুটি চরিত্রের একটি নাটক। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নাটকটি করা হয়ে ওঠেনি। মাসখানেক আগে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি লিরিক বলতে পারবেন কিনা? তখন আলী যাকের বলেছিলেন, ‘আপনারা শুরু করুন, আমি যুক্ত হব’। কিন্তু তিনি আর যুক্ত হতে পারলেন না!
অভিনয়ে খুব নিষ্ঠাবান ছিলেন আলী যাকের। সারাক্ষণ অনুশীলন করতাম আমরা। অভিনয়ের ব্যাপারে সমঝোতা লাগে। আমাদের দুজনের মনের মিল ছিল। এ কারণে আমি তাকে পছন্দ করতাম। তিনিও আমাকে পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, ‘ফেরদৌসী আপনি কোথাও যাবেন না। আপনি গেলে পরে আমি কার সঙ্গে অভিনয় করব?’—এতখানি সম্মান তিনি আমাকে দিতেন। এ রকম একজন অভিনেতার চলে যাওয়ায় মনটা খারাপ। আলী যাকের দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তার পরও কিছু মানুষ চলে গেলে সেই জায়গাটা আর পূরণ হতে চায় না।
শ্রুতলিখন: রাইসা জান্নাত