খেলাপি ঋণ আদায়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের একটি শক্তিশালী কোম্পানি গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ নামের এ কোম্পানি হবে শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি গঠনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আইনটি এখন অংশীজনদের মতামত গ্রহণের পর্যায়ে আছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, পোর্টফোলিও এবং সম্পদের পুনর্গঠনের ক্ষমতা থাকবে এ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে। এ ক্ষমতাবলে কোম্পানিটি স্থাবর ও অস্থাবর সব ধরনের সম্পত্তি অর্জন, দখলে রাখা ও হস্তান্তর করতে পারবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে নিজ নামে যেকোনো আদালতে মামলা করার অধিকার থাকবে কোম্পানিটির।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের অর্থ সরকার থেকে দেয়া হবে এবং সময়ে সময়ে এর পরিমাণ বাড়ানো যাবে। যেকোনো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অনুদান বা পুঁজি সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ পাবে কোম্পানিটি। এছাড়া দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী, ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি বা ফান্ড ম্যানেজারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তহবিল বাড়ানোর সুযোগও থাকছে।
সরকার কর্তৃক নিয়োগ করা একজন চেয়ারম্যানসহ ১৪ সদস্যের সমন্বয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটির পর্ষদ গঠন করা হবে। কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক হিসেবে অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি), দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। এছাড়া থাকবেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদার সাবেক কোনো কর্মকর্তা বা ব্যাংকিং পেশায় ২৫ বছরের অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে সরকার কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবে। পর্ষদ চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের সমমানের। পরিচালকেরা তিন বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং তারা সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে থাকতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার যেসব উদ্যোগ নেয় তার সবই মানুষের কল্যাণের জন্য নেয়া হয়। এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। তবে আশা করা যায় এ কোম্পানি গঠন হলে তা আর্থিক খাতের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
খেলাপি ও ননপারফরমিং ঋণ, অগ্রিম ও বিনিয়োগ আদায় এবং ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আইনে বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে বেশকিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে কোম্পানিটি খেলাপি ঋণ বা অগ্রিম বা বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসায়ের যথাযথ দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ বা কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে পারবে। ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রি বা লিজও দিতে পারবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, যেসব ঋণ ব্যাংক কোনোভাবেই আদায় করতে পারছে না, সেসব ঋণ তুলনামূলক কম দামে কিনে নেবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। ঋণের মান বিবেচনায় ১০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ৪০ কোটি টাকা থেকে ৬০ বা ৭০ কোটি টাকায় কিনে নেবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোও কম টাকাতেই তাদের খেলাপি ঋণ বিক্রি করে দেবে।
কোম্পানিটি ক্রয়কৃত খেলাপি ঋণ আদায়ে খেলাপি ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে নির্ধারিত মেয়াদ প্রদান এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ওই খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করতে পারবে এবং ঋণের গুণগত মান বিবেচনাপূর্বক সম্পূর্ণ বা যেকোনো অংশ শেয়ারে রূপান্তর করতে পারবে।
এজন্য আইনের ধারা ১৫-তে বলা হয়, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পর্ষদের অনুমোদনক্রমে এক বা একাধিক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করতে বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে পরিণত করার লক্ষ্যে কোনো কোম্পানির নিয়ন্ত্রণমূলক শেয়ার কিনতে পারবে। আর আইনের ধারা ২৩-এ বলা হয়েছে, ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসার কর্তৃত্ব গ্রহণ ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা ম্যানেজমেন্ট এজেন্ট নিয়োগ করতে পারবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। তবে এক্ষেত্রে এজেন্ট নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নোটিস করতে হবে।
খেলাপি প্রতিষ্ঠানটি যদি কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি হয় তাহলে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ওই কোম্পানিতে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করতে পারবে। কোম্পানি আইনের বাইরে কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হলে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ওই প্রতিষ্ঠানে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করতে পারবে।
তবে খেলাপি ঋণ আদায়ে এমন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের বিরোধিতা করে আসছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সফলতার মুখ দেখেনি। তাই এখানেও খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন ফলপ্রসূ হবে না। এর বিপরীতে আইএমএফের পক্ষ থেকে ব্যাংকিং খাতে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো ক্ষমতাশালী করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, এখনো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের বিপক্ষে আইএমএফ। তারা ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করে যুক্তি দিয়ে এটার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় অর্থনৈতিক কাঠামো বা ঋণ ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত। তাদের ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হন না। সেখানকার কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলে নিজেরা আবেদন করে দেউলিয়া আইনের মাধ্যমে দায়মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন, এখানে যেমন ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার ঘটনা ঘটে, তেমনি সম্পদের চেয়ে পাঁচ গুণ দায় নিয়েও ব্যবসা চালিয়ে যায়। তাই এ দেশের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে সমস্যা কোথায়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থিক বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, ঋণ আদায়ে একমাত্র সমস্যা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ। যখনই ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপির মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি নিলামের জন্য নোটিস দেয়া হয়, তখনই ব্যবসায়ীরা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এরপর ব্যাংক আর কিছুই করতে পারে না।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ব্যাংকের অনেক কাজ থাকে, তাই তারা সারা দিন কোর্টের পেছনে ছোটাছুটি করতে পারে না। তবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির একটাই কাজ, সেটা হচ্ছে ঋণ আদায় করা। তাছাড়া ব্যাংক যেসব ঋণ আদায় করতে পারছে না, সেসব ঋণ কম দামে কিনে নিয়ে আদায় করে এ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে লাভ করে টিকে থাকতে হবে। তখন এ কোম্পানি ভালো মানের আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে ঋণ আদায় কার্যক্রম শক্তিশালী করবে। ফলে ঋণ আদায় সহজ হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ উদ্যোগে আমি আশাবাদী হতে পারছি না। এ কোম্পানি হবে সরকারি অর্থাৎ সমস্ত পচা ঋণ কিনে নেবে সরকার। ব্যাংকের কাঁধ থেকে ঋণ নেমে গেলেও দায়টা সরকারের কাঁধে পড়ল।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রাইভেট সেক্টরের কোনো কোম্পানি এ পদ্ধতিতে আসবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এলেও কতদিন তারা এটা অপারেট করতে পারবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ সালের পর কোনো কোনো দেশ এ ধরনের কোম্পানি করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের চাপে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে। নানামুখী উদ্যোগেও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য নেই বললেই চলে। করোনা মহামারীতে ক্ষতির কারণে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না করার সুযোগ দেয়ার পরও চলতি বছরের মার্চ-জুন—এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্তিশালী একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। তবে এ কোম্পানির পরিচালনা ও গভর্ন্যান্সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতে পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ছিল, সেটার কিন্তু সাকসেস স্টোরি নেই। তাই এ কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে গভর্ন্যান্স ও ট্রান্সপারেন্সি অবশ্যই মেইনটেইন করতে হবে। তাহলেই এর উপকার পাওয়া যাবে। তা না হলে একটি সমস্যা দূর করতে গিয়ে আরেকটা সমস্যা তৈরি হতে পারে।