ভাইরাসের বিবর্তনে কার্যকর ভ্যাকসিনও ব্যর্থ হতে পারে

বণিক বার্তা ডেস্ক

এইচআইভির বিরুদ্ধে প্রথম ওষুধটি মৃত্যুর দুয়ার থেকে রোগীকে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু যখনই রোমাঞ্চিত হয়ে ডাক্তাররা নতুন রোগীদের ওপর অলৌকিক ওষুধটি প্রয়োগ করেন, তখনই সেটি আর কোনো চমক দেখাতে পারেনি। প্রতিটি রোগীর মাঝে ওষুধ কেবল কিছু সময়ের জন্য কাজ করে।

এক্ষেত্রে এটা প্রমাণিত যে ওষুধটি ভাইরাসকে মারার জন্য খুবই ভালো। কিন্তু ভাইরাস আরো ভালোভাবে বিবর্তিত হয়ে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। ভাইরাসের ভেতর একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশনই মূলত ওষুধকে তার কাজ করার পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ফলে ওষুধ থাকার পরও একটি মিউটেন্ট ভাইরাস তার প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। যা কিনা রোগীকে আবারো অসুস্থ করে দিতে পারে। এরপর বিবর্তন প্রতিরোধী ওষুধের সন্ধান পেতে বিজ্ঞানীদের আরো এক দশক লেগেছিল।

একই ঘটনা কি কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও ঘটবেপ্রাথমিক ট্রায়ালে একটি নিরাপদ কার্যকর ভ্যাকসিন কি ভাইরাসের বিবর্তনের কারণে ব্যর্থ প্রমাণ হতে পারে?

বিবর্তনবাদী মাইক্রোবায়োলজিস্টরা যারা পোলট্রি ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, তারা ভাইরাসটিকে দুটি আলাদা ভ্যাকসিনের প্রতিরোধী হিসেবে বিবর্তিত হতে দেখেছেন। আমরা জানি যে ধরনের ফলাফল আসা সম্ভব। এটা বন্ধ করতে কী লাগে তাও আমরা জানি। কভিড-১৯-এর একটি ভ্যাকসিন ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু উপাদান থাকে, যা ব্যর্থ হয় না।

ভ্যাকসিন প্রতিরোধের ইতিহাস

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ সৌভাগ্যবান। কারণ মানুষের ওপর ব্যবহূত বেশির ভাগ ভ্যাকসিনকে জীবাণুর বিবর্তন দ্বারা হারানো যায়নি। উদহারণস্বরূপ গুটিবসন্তের কথা বলা যায়। গুটিবসন্তের ভাইরাস বিদায় করা গেছে কারণ ভাইরাসটি ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে বিকশিত হওয়ার কোনো পথই খুঁজে পায়নি। পাশপাশি হামের ভাইরাসের কোনো স্ট্রেইনও সামনে আসতে দেখা যায়নি, যা কিনা হামের ভ্যাকসিনকে হারাতে পারে।

কিন্তু এখানে একটা ব্যতিক্রম আছে। একটি ব্যাকটেরিয়া যার কারণে নিউমোনিয়া হয় তা ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয়েছে। সেই ভ্যাকসিনের আরো বিকাশ কিংবা বিকল্প বেশ ব্যয়বহুল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রতিরোধী স্ট্রেইনের উদ্ভব এবং নতুন ভ্যাকসিনের লাইসেন্স পাওয়ার মাঝে সময় লেগেছিল প্রায় সাত বছর।

এটি ছাড়া মানুষের ওপর ব্যবহূত ভ্যাকসিনের আর কোনোটিই এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু ইঙ্গিত আছে যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া পরজীবী বিবর্তিত হতে পারে কিংবা ভ্যাকসিনেশনের প্রতিক্রিয়ায় বিবর্তন দেখাতে পারে।

মানুষের কিছু রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ট্রাইপোনোসোমিয়াসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা এইডসের ভ্যাকসিন বানানো কঠিন কিংবা একরকম অসম্ভব। কারণ এসব রোগের যেসব অণুজীব তা খুব দ্রুত বিবর্তিত হতে পারে। তবে অন্য ক্ষেত্রে যেমন প্রাণিজ ভ্যাকসিনগুলো প্রায়ই ভাইরাল বিবর্তন দ্বারা প্রতিহত হয়।

এটা দেখতে কেমন হবে?

যদি সার্স-কোভ- ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়ায় বিবর্তিত হয়, তবে বেশকিছু দিক দিয়ে সেটি হতে পারে। ফ্লু ভাইরাসের ক্ষেত্রে কী ঘটে তা বেশ সুস্পষ্ট। ইমিউনিটি কাজ করে যখন অ্যান্টিবডি কিংবা ইমিউন সেল ভাইরাসের পৃষ্ঠের কণাগুলোর সঙ্গে আবদ্ধ হয়। যদি ভাইরাস পৃষ্ঠ কণাগুলোতে মিউটেট হয়, তবে অ্যান্টিবডি তাদের শক্তভাবে আটকাতে পারবে না এবং ভাইরাস বাধা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে। প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে কেন মৌসুমি ফ্লুর ভ্যাকসিন প্রতি বছর আপডেট করতে হয়। যদি কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটে, তবে ভাইরাসের ভ্যাকসিনকেও প্রতি বছর আপডেট করতে হবে।

কিন্তু বিবর্তন অন্য পথেও চালিত হতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো হয়, যদি ভাইরাস সুপ্তভাবে বিবর্তিত হয়, এটা সম্ভবত হতে পারে শ্লথভাবে পুনরুৎপাদিত হয়ে কিংবা কোনো অঙ্গের মাঝে লুকিয়ে, যেখানে ইমিউনিটি কম কার্যকর থাকে। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক রোগজীবাণু পথ গ্রহণ করে। তারা চিহ্নিত হওয়া এড়াতে পারে, কারণ তারা তীব্র রোগের কারণ হয় না।

অধিক বিপজ্জনক উপায়ে এটি হতে যারে যদি ভাইরাস ভ্যাকসিনের ইমিউনিটি তৈরির তুলনায় দ্রুত প্রতিলিপি করে বিবর্তিত হতে পারে। ইমিউন সিস্টেমকে লক্ষ করা ভাইরাসের আরেকটি কৌশল হতে পারে, যেখানে ভ্যাকসিন প্ররোচিত ইমিউনিটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। আমাদের ইমিউন সিস্টেমে আরো শক্তিশালী উপায়ে হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমেও মানুষের শরীরের অনেক ভাইরাস টিকে থাকতে পারে। যদি সার্স-কোভ- আংশিকভাবেও আমাদের ইমিউনিটিকে নিষ্ক্রিয়  করে, তবে কভিড ভ্যাসকিন মিউটেন্টের পক্ষে যেতে পারে।

বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিন

বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করাকে উচ্চতর কার্যকারিতার সঙ্গে দমন করতে পারে। এর ফলে পরবর্তী সংক্রমণ দমন করা যায়। অর্থাৎ, প্রতিলিপি না হলে সংক্রমণ হয় না এবং বিবর্তনও হয় না। দ্বিতীয়ত, বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিন ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে প্ররোচিত করতে পারে, যা কিনা একই সময়ে জীবাণুর বিভিন্ন অংশে আঘাত হানতে পারে। ভাইরাসের জন্য একটি আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে নিজেকে মিউটেট করা সহজ। কিন্তু অনেকগুলো সাইট থেকে যদি একই সময়ে আক্রমণ করা হয়, তখন ইমিউনিটির হাত থেকে বাঁচতে আলাদা আলাদা অনেকগুলো বিবর্তন একসঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, তবে সেটি প্রায় অসম্ভব। এটা ল্যাবরেটরিতে এরই মধ্যে সার্স-কোভ--এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। অ্যান্টিবডি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত হলে তবে ভাইরাস দ্রুত প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু অ্যান্টিবডির একটি ককটেইল যখন চালিত হয় এবং একাধিক ক্ষেত্রকে যখন লক্ষ্য করা হয় তখন প্রতিরোধ তৈরি করা ভাইরাসের জন্য কঠিন। তৃতীয়ত বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিন সব প্রচলিত স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে। ফলে একটিকে দূর করা হলে অন্যটি সে স্থান দখল করতে পারে না।

কভিড ভ্যাকসিন কি বিবর্তন প্রতিরোধী হবে?

প্রায় ২০০-এর মতো কভিড ভ্যাকসিন প্রার্থী বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এখনই এটা জানা সম্ভব না যে এর কতটার বিবর্তন প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সৌভাগ্যবশত লাইসেন্স পাওয়া একটি ভ্যাকসিন ব্যর্থ হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না। ভ্যাকসিন ট্রায়ালে থাকা অবস্থায়ই একটু বাড়তি প্রচেষ্টা সেটি বিবর্তন প্রতিরোধী কিনা তা জানার পথে এগিয়ে দেবে।

পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের সোয়াব নেয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন ভাইরাস স্তর কতদূর পর্যন্ত দমন করা যায়। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী মানুষের মাঝে কোনো ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে হয়তোবা ক্রিয়াকলাপে বিবর্তনীয় পলায়নপরতা দেখতে পাওয়া সম্ভব। এছাড়া ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের রক্ত সংগ্রহ করে আমরা ল্যাবে দেখতে পারি ভাইরাসের কতগুলো সাইট ভ্যাকসিন প্ররোচিত ইমিউনিটি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।

বিশ্বের কভিড ভ্যাকসিন ভীষণভাবে প্রয়োজন। এখন সব বাধা অতিক্রম করে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রত্যাশাই সবার।

স্ক্রলডটইন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন