আলোকপাত

কৃষির ৫০ বছর: অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

ড. এম আসাদুজ্জামান

(গতকালের পর)


ভবিষ্যৎ পাঁচ দশক

ভবিষ্যতে কৃষিতে কী ঘটতে পারে তা নির্ভর করবে কৃষির বাইরের কিছু নিয়ামকের ওপর। প্রথমটি হলো জনসংখ্যা ও আয় পরিবর্তন। উভয়ই খাদ্যের মোট চাহিদা এবং এর কাঠামোর ওপর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৬১ সালে দেশের জনসংখ্যা আনুমানিক ২১০ থেকে ২৫০ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে। এর মধ্যে একটি মধ্যম সংখ্যা হলো ২২৩ মিলিয়ন। কোনো কিছু তেমন পরিবর্তন না হলে মধ্যম সংখ্যার হিসাবে খাদ্যের চাহিদা প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে। অবশ্য আয় পরিবর্তনের বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে। মহামারীর ঠিক আগে স্থির মূল্যে মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৮ শতাংশ হারে উন্নীত হয়েছিল। তার অর্থ হলো, শেষ হিসাবে প্রতি বছর আমাদের মাথাপিছু জিডিপি কম-বেশি ৬ শতাংশ হারে বাড়ছিল। এর মানে হলো, এই গতিবেগ বজায় থাকলে আনুমানিক আগামী ১২ বছর বা ২০৩০ সালের পর পরই মাথাপিছু জিডিপি দ্বিগুণ হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, মহামারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির করে দিয়েছে এবং আগের রেশ ফিরিয়ে আনতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। অবশ্য আর যদি বিচ্যুতি না-ও ঘটে তাহলেও সম্ভবত আগের প্রবৃদ্ধির পথে যেতে দুই-তিন বছর লাগবে। 

আমরা এরই মধ্যে জানি যে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী অংশত বা পুরোপুরিভাবে নিজেদের জীবিকা হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সরকারি খাত মোটামুটি অক্ষত থেকেছে। আনুষ্ঠানিক ব্যক্তি খাত বড় মাত্রায় অভিঘাতের শিকার হয়েছে এবং এখনো পুরোপুরি নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো এখনো টিকে থাকার লড়াই করছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। 

সাধারণত আয় বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যে ব্যয়ের অনুপাত পড়ে যায়; যদিও শস্যভিত্তিক থেকে অধিক পুষ্টিনিবিড় প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাবার যেমন দুধ, ফলফলাদি ও শাকসবজি খাওয়ার ঝোঁক বাড়ে। সময়ের আবর্তে ভাত খাওয়া থেকে সরে আসার বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যদিও খুব ধীরে ধীরে। এখন মানুষ শস্যবহির্ভূত খাদ্যের দিকে ঝুঁকেছে। আয়ে মহামারীজনিত হঠাৎ পতন এক্ষেত্রে আবার বেপথু করতে পারে। যেহেতু পুষ্টিনিবিড় শস্যবহির্ভূত খাদ্য সাধারণত অধিক ব্যয়বহুল, মানুষ হয়তো ভাতের প্রতি আবারো ব্যাপকভাবে ঝুঁকতে পারে। কাজেই স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদে মাথাপিছু ভিত্তিতে চালের চাহিদা বাড়তে পারে; তবে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিধায় স্বাভাবিক প্রবণতাগুলো আশা করা যায় ধীরে হলেও পুনরায় শুরু হবে।  

এ বাস্তবতায় উল্লেখ করা দরকার যে বোরো ধান মোটামুটি ঠিকমতো তুলে আনার কারণে সব খাতের মধ্যে কৃষি, বিশেষ শস্যভিত্তিক কৃষি, সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে শাকসবজি ও ফলফলাদির সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বাজারে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছতে পারেনি বলে কৃষকদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। আরো বেশি লোকসান হয়েছে পোলট্রি ও দুগ্ধ খামারিদের। মাছ চাষ সম্ভবত তুলনামূলক কম লোকসানে পড়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ায় সেগুলো অবশ্য আবার আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। কাজেই স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদে অনেকেই মনে করেন যে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রায় মন্দা থেকে উত্তরণে কৃষি অন্যতম প্রধান কৌশল হতে পারে। অবশ্য সেটি সম্ভব করতে হলে সরবরাহ শৃঙ্খলের ইস্যু, কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত, পচনশীল পণ্যের যথাযথ সংরক্ষণের সুবিধাসহ বিপণন অবকাঠামো আধুনিকায়ন করতে হবে এবং অপচয় কমাতে যথাযথ পরিবহনের জন্য আধুনিক যানবাহন ব্যবস্থা সংযোজন করতে হবে। এসব বিষয়ে উন্নতি ঘটাতে সরকারকে কৃষিপণ্যের উৎপাদনস্থল ও গন্তব্যস্থল উভয় ক্ষেত্রে যথাযথ প্রযুক্তি প্রবর্তন ও অর্থায়ন নীতিগুলো নতুনভাবে বিন্যাস করার নীতি ও প্রণোদনা ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। বড় বড় শহরকেন্দ্রে অবস্থিত সুপারমার্কেটগুলো এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

তবে আমাদের অন্য চ্যালেঞ্জগুলোও ভুললে চলবে না। বর্তমান খাদ্য ব্যবস্থায় একটি বড় ইস্যু পুষ্টিগত ভারসাম্যহীনতা। খর্বত্ব, কম ওজন, কৃশকায়ত্ব, ক্ষুদ্র পুষ্টিকণাজনিত ঘাটতি এখনো বেশি এবং ভয় আছে যে চলমান মহামারী এসব সমস্যা আরো তীব্র করতে পারে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং প্রবৃদ্ধি হারে অবনমন ঘটাবে।  

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তন। কয়েকটি বিষয় ঘটতে পারে। সবিস্তারে না গিয়েও বলা যায়, সব ফসলের উৎপাদন কমতে পারে। মাছ, দুধ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির উৎপাদনও কমে যেতে পারে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জীবনচক্র পরিবর্তনের কারণে। গবাদিপশুর প্রজননক্ষমতাও কমতে পারে। সবকিছু ছাপিয়ে জলবায়ুসংক্রান্ত দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা ও ভয়াবহতা উভয়ের দিক থেকে প্রকোপ বাড়তে পারে। 

বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে পানি নিয়ে আমাদের অনেক সমস্যা হবে। অসময়ে বৃষ্টিপাত কিংবা ভারি বৃষ্টিপাত, ভয়াবহ ও ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি ঘটনা ঘটবে। এসব বিষয় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান। কম বৃষ্টিপাতের কারণে পুনর্ভরণের অভাবে ভূর্গভস্থ পানির সংকট, খরা এবং আঞ্চলিক পানি সংকট ও অমীমাংসিত আন্তঃসীমান্ত সমস্যার কারণে অনিশ্চিত উপরস্থ পানিপ্রবাহ বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি করবে। যথাযথ অভিযোজন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা না হলে উল্লিখিত ইস্যুগুলোর প্রভাবে খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের পতন ঘটবে, যা ব্যাপকভাবে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তাহীনতার অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। আর যদি তেমনটি ঘটে তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে আমাদের আশা করা অনেক সুফল বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই এসব সমস্যার সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। কৃষিতে সেচ পানির সংরক্ষণ, প্রযুক্তি প্রবর্তন এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনা ব্যবস্থার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব বিষয় যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে হবে এবং পানি সংকটের পরিণাম রুখতে আমাদের নিজেদেরই পানি ব্যবস্থাপনার এক বা একাধিক  নতুন পদ্ধতি বের করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে দেশে এরই মধ্যে পানির প্রকৃত সামাজিক মূল্য বের করার একটা চেষ্টা চলছে। এটি হলে বিভিন্ন খাতে পানি ব্যবহার ও সংরক্ষণসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে ফসল ও পশুর জীবনচক্রের দিক থেকে বিষয়গুলো কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটি লক্ষ রাখতে হবে—যাতে নতুন টেকসই জাতের উন্নয়ন ঘটানো যায় কিংবা বর্তমানে থাকা জাতের মধ্যে কোনগুলো কম সংবেদনশীল, সেগুলো চিহ্নিত করা যায় এবং প্রণোদনা, প্রযুক্তি ও অর্থায়নের মাধ্যমে সেগুলো কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করা যায়।

এসব বিষয় ব্যাপকতর গবেষণা পদ্ধতি ও বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তি সৃষ্টি ও এর অধিকতর উন্নয়ন দাবি করে। আমরা জানি, সরকার তার জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল হালনাগাদের পাশাপাশি একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। উভয়টির ক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা কৃষকবান্ধব ও বিজ্ঞানভিত্তিক করার বিষয়টিতে পর্যাপ্ত দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে হবে।  

উপসংহার

আমরা এখানে গত পাঁচ দশকের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি। উল্লিখিত সময়ে কৃষিতে লক্ষণীয় বেশকিছু অর্জন থাকলেও প্রধান কিছু ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। সেগুলো এখনো দূর করার যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এসব ঝুঁকির কিছু তদারকি ও তথ্য সংগ্রহের যথাযথ পদ্ধতির ঘাটতি এবং আরো পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান ভিত্তি অবস্থা ও সময়ান্তরে এর পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করার বিষয়টি বিশ্লেষণের অভাবে সৃষ্ট। পুরনো সরবরাহ শৃঙ্খল ও বিপণন ব্যবস্থা এবং সরকারের মূল্য সহায়তা ব্যবস্থা যথাযথ না হওয়ায় সেগুলোর আরো অবনমন ঘটেছে, যা কৃষকের জন্য কৃষিকাজ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহমূলক। অন্যগুলো প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটের কারণে, যার মধ্যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটি কাজ করে। এর ফল হলো, কৃষকদের নিম্ন আয় এবং একটি বড়সংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টিহীনতা সৃষ্টি। এসব ঝুঁকি ছাড়াও রয়েছে পানির মতো সম্পদ ব্যবহারে অদক্ষতা এবং নিম্ন উৎপাদনশীলতা ইস্যু। চলমান মহামারীতে পুরো ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো ফুটে উঠেছে, কিন্তু ব্যবস্থাটি আগের জায়গায় ফিরতে বেশকিছু সময় নিতে পারে। কিন্তু আগের অবস্থা ও ব্যবস্থায় ফিরলে চলবে না। দুটোরই পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমান মহামারী আমাদের নতুনভাবে সে চিন্তা ও তার রূপায়ণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাকে কাজে লাগাতে হবে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ অনেক। এর মধ্যে একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার জন্য খুব প্রতিকূল ও কঠিন অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। চলমান মহামারী থেকে বেরিয়ে আসতে কৃষির একটি প্রস্থান কৌশল থাকতে হবে এবং খাতটিকে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তিতে পরিণত করতে হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সুশাসনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে কৃষকদের ন্যায্য প্রাধান্য দিতে হবে। (শেষ)

(ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস ও হুমায়ুন কবির)


ড. এম আসাদুজ্জামান: সাবেক গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন