নেপালের সমাধান কার হাতে?

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

এক বছরেরও বেশী সময় ধরে ভারত-নেপাল সীমান্ত উত্তেজনা চলছে। নেপালের পার্লামেন্ট তিনটি বিতর্কিত অঞ্চল কালাপানি, লিলুলেখ ও লিম্পিওয়াধুরাকে নিজেদের মানচিত্রের অংশ হিসাবে পাস করলে দিল্লির নীতি নির্ধারকদের চোখ রীতিমতো কপালে উঠে। কাঠমুন্ডু নিয়ে দিল্লির এই অস্বস্তির মধ্যেই গত জুন মাসের শেষের দিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কেপি শর্মা ওলি অভিযোগ করেন, তাকে উৎখাতে ভারতীয় ষড়যন্ত্র চলছে। তার দাবি পার্লামেন্টে তাকে অপসারিত করা হতে পারে। রাজনীতির টালমাটাল সময়ে পার্লামেন্টারি ভোটে ওলির অপসারণের আশঙ্কা অমূলক নয়। আস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী পাল্টানো নেপালি সংসদ সদস্যদের কাছে মামুলি ব্যাপার। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১১ জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে নেপাল। কিন্তু তিনি অপসারণে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ খুঁজে দিল্লির নীতিনির্ধারকদের ফের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন। তবে ভারতীয় মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, শর্মা ওলি জাতীয়তাবাদ উস্কে দিতে ভারতের বিরুদ্ধে বিষাদগার করছেন। সম্প্রতি ভারতীয় শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে শর্মা ওলির একান্ত বৈঠকের ফলে ওলির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিরোধীরা।

নেপালে ১৯৬০-১৯৭২ সাল পর্যন্ত  রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধের সময়ে দলগুলো ভারত থেকে কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। এমনকি নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে ১৯৪৯ সালে কলকাতায়। ২০০১ সালে ভারতপন্থি জ্ঞানেন্দ্র রাজা হলে মাওবাদীর সাথে গৃহযুদ্ধ চরমে উঠে। তখন সমঝোতা করতে গিয়ে মাওবাদীদের সাথেও দিল্লির বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। ফলে নেপালের রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নয়াদিল্লির প্রভাব প্রশ্নাতীত।

নেপালের ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপান সরকার বর্তমান ওলি সরকারের উপর সন্তুষ্ট না। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষিণ এশিয়া সফরের তালিকায় শ্রীলঙ্কা মালদ্বীপ থাকলেও নেপাল না থাকায় এই অসন্তুষ্টি আরও প্রকাশ্য হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বন্ধুদের নিয়েও স্বস্তিতে নেই ওলি সরকার।

তবে সব ছাড়িয়ে নেপালের রাজনীতিতে এখন আলোচনা চলছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং বা র’ এর প্রধান সামন্ত কুমার গোয়েলের নেপাল সফর। করোনা কালে ভারত-নেপাল বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও বিশেষ বিমানে কাঠমুন্ডু পৌঁছান গোয়েল। তার ১৬ ঘণ্টার এই সফরে তিনি তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে দেখা করেন নেপালি প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সাথে। এই সফর ও বৈঠক নিয়ে তীব্র সমালোচনায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ওলি। নিজ দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে বিরোধী দল তাকে এক হাত নিয়েছেন। তাদের দাবি গোয়েলের এই সফর ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানা হয়নি। বলা হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ বার্তা নিয়ে গোয়েল কাঠমুন্ডু সফর করেছেন। সাধারণভাবে বিশেষ দূত হিসাবে রাজনীতিবিদ বা কূটনীতিকরা যায়। কিন্তু এখানে গিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা। এই সফরের  পূর্ব কোন ঘোষণা ছিল না। বৈঠক হয়েছে শর্মা ওলির বালুওয়াটার বাসভবনে। সামন্ত গোয়েলের পক্ষ থেকে তিনজন থাকলেও মি. অলির পক্ষ থেকে বৈঠকে তিনি একাই উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের কোন কর্মকর্তা ছিল না। ফলে নেপালিরা প্রশ্ন তুলছে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা শর্মা ওলি নিজেই কী ভারতের কাছে আজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন!

এখানে আলোচ্য শর্মা ওলি ভারত বিরোধী এজন্ডো দিয়ে নির্বাচনে জিতে এসেছেন। দেশে প্রথম সাংবিধানিক নির্বাচনে ২০১৭ সালে একত্রিত কমিউনিস্ট পার্টি জিতলে শর্মা অলির সাথে পুষ্প কমল দহলও প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার ছিলেন।  আলোচনা আছে চীনের সাথে পূর্বের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদে ট্রান্সপোর্ট ও ট্রানশিট চুক্তির অভিজ্ঞতা ও ভাল সম্পর্ক ওলিকে প্রধানমন্ত্রীত্ব এনে দেয়। ফলে ভারতের সাথে মানচিত্র উত্তেজনার শুরু থেকে পুষ্প কমল দহল শর্মা ওলির ‘অতি ভারত বিরোধিতা’র সমালোচনা করে দিল্লির নজর কাড়ার চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ওলি কোন সংকটে পড়লে দলের সিনিয়র নেতা মাধব কুমারের কাছে যেতেন পরামর্শের জন্য। কিন্তু জুলাই মাসের বাজেট অধিবেশনে নিজ দলের একাংশের শীর্ষ নেতা পুষ্প কমল দহলের সাথে মাধব কুমারও মি. ওলির পদত্যাগ দাবি করেন। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী ওলি বাধ্য হয়ে অধিবেশন মূলতবি করেন। 

এসব উত্তেজনার মধ্যে দল ভাঙার গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। মি. ওলি বলেছেন যেকোন মুহূর্তে দল ভেঙে যেতে পারে। তার সহযোদ্ধা ও বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বী পুষ্প কমল দহলকে নিজ সিদ্ধান্তে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকাকে দল ভাঙার শামিল হবে বলে সতর্ক করেন। জবাবে মি. দহল বলেন, ‘আপনি আপনার অনুগতদের নিয়ে বৈঠক করেছেন আমিও আমার অনুগতদের নিয়ে বৈঠক করব।’ নেপালের দুই কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মার্ক্সবাদি, লেনিনবাদি), নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) কে একত্র করে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার পেছনে চীনের ভূমিকা ছিল। এর মাধ্যমেই কাঠমুন্ডুতে চীন প্রভাব বিস্তারের জাল ফেলে। সে দল ভেঙে যাওয়া দিল্লির জন্য স্বস্তিদায়কই হবে।  তবে দল ভেঙে গেলে তার জন্য অন্যতম দায়ী হবে দল ও সরকারের অভ্যন্তরে কেপি শর্মা ওলির একগুয়ে সিদ্ধান্ত। গত অক্টোবরে তিনি নিজ সিদ্ধান্তে মন্ত্রী সভায় বেশ কিছু রদবদল করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইশ্বর পোখারেলকে সরিয়ে দেওয়া। ভারতের বিরুদ্ধে মি. পোখারেলের বেশ কঠিন মন্তব্য ছিল। সমালোচনা আছে র’ প্রধান ও ভারতীয় সেনাপ্রধানের সফর উপলক্ষে ভারতকে সন্তুষ্ট করতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যে জাতীয়তাবাদী চেতনায় ভর করে তিনি এতদিন টিকে ছিলেন তা খসে পড়তে শুরু করেছে। ভারত বিরোধীরাও তাকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।

বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ভারতের বিশ্বস্ত পুষ্প কমল একজন মাওবাদী। ২০০৬ সালেও মাওবাদীকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় রেখেছিল ভারত। আর ২০১৫ সালের অবরোধের আগে মি.ওলিই ছিল ভারতের পছন্দের ব্যক্তি। 

সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ভারতীয় সেনাপ্রধানের নেপাল সফর নিয়ে আলোচনা চলছে। সফরে ভারতের সেনাপ্রধানকে জেনারেল পদবি দেওয়া হয়। সেনাপ্রধানের সাথে প্রধানমন্ত্রী ওলির বৈঠকের পর তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা রাজন ভট্ট রায় বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে আমরা ভারতের সাথে বিরোধের সমাধান চাই।’ ওলি সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আলোচনার আহবানই জানানো হচ্ছিল। এতদিন পর দিল্লি যদি সফরের মাধ্যমে সে আহবানকে গ্রহণ করে তবে তা ওলি সরকারের বিজয় বলা যায়। 

তবে প্রশ্ন হচ্ছে নিজ দলে এত বিবাদ নিয়ে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন শর্মা ওলি! মি. গোয়েলের সাথে বিশেষ বৈঠকে তিনি কী তার সরকারের প্রতি দিল্লির সমর্থন চাইলেন? এসবের মাঝেও ওলির সরকার চীনের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখছে। ফলে কাঠমুন্ডুর থেকে থেকে রাজনৈতিক উত্তেজনায় চীন কতক্ষণ দর্শক হয়ে থাকছে তাও দেখার বিষয়। 

 লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন