ভ্যাকসিন বরাদ্দে কেমন হবে ইউরোপের কৌশল?

বণিক বার্তা ডেস্ক

একে একে সামনে আসতে শুরু করেছে ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীনের পর চূড়ান্ত ফলও প্রকাশ করেছে ফাইজার বায়োএনটেক। পাশাপাশি মডার্নাও জানিয়েছে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন ফল। দুটি ভ্যাকসিনই এরই মধ্যে ৯০ শতাংশের অধিক কার্যকারিতার কথা জানিয়েছে। এসব ফল সামনে আসার পরপর ক্রিসমাসের আগেই এর বিতরণ নিয়ে আলাপ করেছেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা, এমনটা জানিয়েছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক। অন্যদিকে ইংলিশ চ্যানেলের আরেক পাশে থাকা ফ্রান্সও অন্য উপায়ে ভ্যাকসিন বিতরণ করতে প্রস্তুত। একইভাবে কৌশল নির্ধারণ করছে জার্মানি, ইতালি স্পেনসহ অন্যরাও। 

যুক্তরাজ্যে কারা আগে ভ্যাকসিন পাবে তা নিয়ে সরকার পরামর্শ গ্রহণ করছে তাদের জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন থেকে। ভ্যাকসিনের অনুমোদন-সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠানে কমিটিটি যে কৌশল প্রস্তাব করেছে তা হলো ভ্যাকসিন দেয়ার ক্ষেত্রে অধিক বয়স্কদের, স্বাস্থ্য সামাজিক সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের যেন অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

ফ্রান্সে সরকারি নীতি বেশ কয়েকটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে, যেখানে লে কাউন্সিল সায়েন্টিফিক, লে কাউন্সিল অ্যানালিস রিসার্চ ইটি এক্সপার্টাইজ অন্তর্ভুক্ত থাকে। যা কিনা খসড়া নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছে।

এখানে যুক্তরাজ্যের কৌশলের সঙ্গে কিছুটা মিলও রয়েছে, যেমন স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পার্থক্যও রয়েছে। একটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে ফরাসি নিদের্শনায় উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন পেশাকেও রাখা হয়েছে, যেমন দোকানে কাজ করা কর্মীরা, স্কুল স্টাফ, পরিবহন শ্রমিক, হসপিটালিটি খাতে কর্মীরা এবং বধ্যভূমিতে যারা কাজ করে তারা।

আলাদা প্রক্রিয়া কেন?

যুক্তরাজ্যে জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, বয়সভিত্তিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা সহজ। তাছাড়া আপনি যদি যেকোনো একটি ফ্যাক্টর ধরে এগোনোর পরিকল্পনা করেন, সেখানেও বয়স একটি ভালো ফ্যাক্টর, কারণ প্রতি পাঁচ বছরের ব্যবধানে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।

তবে বয়স ছাড়া আরো এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যা কিনা কভিড-১৯- রোগীদের মৃত্যুর জন্য আরো বেশি ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, যেমন ডায়াবেটিস থাকা বয়স পাঁচ কিংবা দশ বছর বেশি হলে যেমন ঝুঁকি থাকে তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ।

কারো গুরুতর কভিড-১৯- আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে এমন একটি অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়, যা বেশ কয়েকটি ঝুঁকির কারণ হিসেবে কাজ করে। যা এটি নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে যে প্রতিটি বয়স গোষ্ঠীর যারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারে, তাদের উদ্দেশ্য করে ভ্যাকসিন চালিত হবে।

এখানে আমরা ফ্লু ভ্যাকসিন গ্রহণের যে প্রমাণগুলো সামনে আছে তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। এগুলোরও লক্ষ্য হচ্ছে অধিক বয়স্ক মানুষ (যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি) তবে এর পরও চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে। যেখানে দরিদ্র মানুষের ইমিউনাইজড হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই যুক্তরাজ্যের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তাকে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও ভ্যাকসিন পেতে পারে।

অন্যদিকে ফ্রান্স সরকারের প্রক্রিয়াটিতে উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন পেশায় কাজ করাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মহামারীর প্রথম ঝড় যখন শুরু হয় তখন নির্দিষ্ট পেশার লোকজনের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল। যেমন রাইডশেয়ার করে যারা ট্যাক্সি ড্রাইভাররা অধিক ঝুঁকিতে ছিল। (এসব বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্সের বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে পেশাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে) এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও মৃত্যুর ঝুঁকি অধিক। তবে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে ৫০ বছর বয়সের কম অনেক কর্মী রয়েছে, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে, তাদের ভ্যাকসিন বরাদ্দের ক্ষেত্রে কীভাবে যুক্ত করা হবে সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।

একটি বিষয় যা ফ্রান্স যুক্তরাজ্য উভয় দেশের কমিটিকে বিবেচনা করতে হবে তা হলো কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন সামনে আসবে মহামারীর দ্বিতীয় ঝড় চলাকালেই, যেখানে সংক্রমণের হারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকবে। লন্ডন অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যেও মৃত্যুহারের দিক থেকে প্রথম ওয়েবের তুলনায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

জনগণের পরামর্শ

সুপারিশের দিক থেকে পার্থক্যের বাইরে দুটি দেশের জনগণের পরামর্শের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা টেকনোলজিগুলোর বিপরীতে যুক্তরাজ্যের অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশনা জনগণের আনুষ্ঠানিক পরামর্শের সাপেক্ষে তৈরি করা হয়নি।

বিপরীতে ফ্রান্স সরকার বর্তমানে অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করার ক্ষেত্রে জনগণের পরামর্শকে বিস্তৃতভাবে যুক্ত করার কাজে নিয়োজিত আছে। প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিন বরাদ্দের কৌশলগুলোর যে ডিজাইন তাতে জনগণের প্রস্তাবকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তথ্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে কার্যকরভাবে কৌশলগুলো জনগণকে জানানোর জন্য। 

ধরনের পরামর্শ পদ্ধতি সময় ক্ষেপণ করে। কিন্তু এর কিছু শক্তিশালী সুবিধাও রয়েছে, যেখানে এটা সরকারকে সাহায্য করে জনগণ কী চায় তা বুঝতে। পাশাপাশি এটা পরবর্তী অগ্রাধিকার নীতি যোগাযোগ কৌশলকে শুদ্ধীকরণেও সহযোগিতা করে। ফলে সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হতে পারে আরো বেশি মানুষ ভ্যাকসিন বরাদ্দে যে নির্দেশনা তাকে সমর্থন করছে।

দুটি সরকারের নীতিকে পর্যালোচনা করার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে বিভিন্ন দেশে আরো ভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন বরাদ্দের কৌশল থাকবে। যেখানে কারা আগে ভ্যাকসিন পাবে সেই বিষয়টি আলাদাও হতে পারে। কভিড-১৯ ভ্যাকসিন বরাদ্দের কাঠামোটি বলছে, এই বিভিন্ন মানদণ্ডে কৌশলগুলো বিবর্তিত হতে পারে। বিশেষ করে জনগণের মত নেয়ার পর। জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনস স্পান বলেছেন, শুরুতে জনগণের সবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন থাকা অসম্ভব। তাই ন্যায্যভাবে ক্রম অনুসারে বণ্টনই হচ্ছে লক্ষ্য। সেক্ষেত্রে হাসপাতাল কেয়ার সেন্টারে চাপ কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে তারাও বয়স্কদের আগে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা বিবেচনা করছে। জার্মানিতে ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক লোকের সংখ্যা ২৩ মিলিয়ন। এরপর তারা যুক্ত করবে জরুরি কাজে নিয়োজিতদের। যেখানে  স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই পদ্ধতি ধরে এগোচ্ছে স্পেন ইতালিও। স্পেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালভাদর ইলা বলেছেন, তারা স্বাস্থ্যসেবাকর্মী বয়স্কদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। অন্যদিকে ইতালি সামরিক সদস্য এবং পুলিশ সদস্যদেরও প্রথমদিকে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা বিবেচনা করছে। তবে যে কৌশলই নেয়া হোক না কেন, যখন আমাদের হাতে কোনো একটি কার্যকর ভ্যাকসিন থাকবে, তখন সেটি ন্যায্যভাবে উপযুক্তভাবে বরাদ্দ দেয়াই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি।

স্ক্রলডটইন দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন