ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং

এমডি চলে যাওয়ার পরই শেয়ার বিক্রির হিড়িক বিদেশীদের

মেহেদী হাসান রাহাত

ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ে (ডিবিএইচ) দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কিউএম শরীফুল আলা। তার প্রস্থানের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে নিজেদের অধিকারে থাকা ডিবিএইচের সাড়ে ১৭ শতাংশেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চার বিদেশী বিনিয়োগকারী।

প্রায় দুই যুগ আগে ১৯৯৭ সালে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ডিবিএইচ লিমিটেডে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দেন কাজী মোহাম্মদ শরীফুল আলা, যিনি কিউএম শরীফুল আলা নামেই বেশি পরিচিত। তার মেয়াদে দেশের আবাসন খাতে অর্থায়নকারী অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ডিবিএইচ। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিনিয়োগ করেছেন ডিবিএইচের শেয়ারে। চলতি বছরের জুন শেষে শরীফুল আলা ডিবিএইচের এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তার দায়িত্ব ছাড়ার দুই মাস পর সেপ্টেম্বরে চার বিদেশী বিনিয়োগকারী তাদের কাছে থাকা ডিবিএইচের ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এমডি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ডিবিএইচের শেয়ারহোল্ডিং তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগ ছিল ১৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সেখান থেকে ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে গত বছরের শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারে বিদেশীদের মালিকানার হার দাঁড়ায় ৪২ দশমিক শূন্য শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে তা দাঁড়ায় ৪০ দশমিক ৮৮ শতাংশে। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে থাকেন বিদেশীরা।

ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটিতে ২৭ জন বিদেশী বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ থাকলেও মার্চে একজন তার পুরো বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে চলে যান। জুলাইয়ে ডিবিএইচে বিদেশীদের বিনিয়োগ ছিল ৪০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বছরের আগস্টে এসে আরো একজন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটিতে থাকা তার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন। ওই সময় ২৫ জন বিদেশী বিনিয়োগকারীর কাছে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার মালিকানার হার দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

এরপর সেপ্টেম্বরে একসঙ্গে চারজন বিদেশী বিনিয়োগকারী ডিবিএইচ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশীদের শেয়ার মালিকানার হার দাঁড়ায় ২২ দশমিক শূন্য শতাংশ। সর্বশেষ গত মাসের শেষে প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশীদের বিনিয়োগ আরো কমে ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সে অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশীরা প্রতিষ্ঠানটির ২০ শতাংশেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন।

বছরের মার্চে পুঁজিবাজারে দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেয়। এক্ষেত্রে ডিবিএইচের শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস দাঁড়ায় ৯২ টাকা ৬০ পয়সায়। ফ্লোর প্রাইসের কারণে মার্চের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার বিক্রি হয়নি বললেই চলে। তবে আগস্ট সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারমূল্য ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে বেড়ে যায়। সময়েই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তাদের মালিকানাধীন শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা যায়।

সুদীর্ঘ ২৩ বছরের এমডির চলে যাওয়ার সঙ্গে বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির সংযোগের বিষয়ে বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এর পরিচালন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন। ফলে একজন দক্ষ যোগ্য এমডির ওপর প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স অনেকাংশে নির্ভর করে। এজন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির আর্থিক নির্দেশকগুলোর পাশাপাশি প্রধান নির্বাহীর দক্ষতা যোগ্যতার বিষয়টিও পর্যালোচনা করে থাকেন। সে হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ডিবিএইচকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে যিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তার চলে যাওয়ার বিষয়টি বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির অন্যতম একটি কারণ বলে জানা গেছে। তবে বছরের সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা ছিল বেশি।

প্রায় দুই যুগ দায়িত্ব পালনের পর কিউএম শরীফুল আলা কেন আর ডিবিএইচের দায়িত্বে থাকতে চাননি, সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। গত বছরের শেষদিকেও একবার তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তবে সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ সদস্যদের অনুরোধে তিনি দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে সম্মত হন। বছরের জুন পর্যন্ত ডিবিএইচের এমডি হিসেবে তার চুক্তির মেয়াদ ছিল। মেয়াদ শেষে তিনি আর নতুন করে চুক্তি করতে সম্মত হননি। ফলে বছরের জুলাই ডিবিএইচের সঙ্গে তার সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পথচলার সমাপ্তি ঘটে।

ডিবিএইচের শেয়ার বিক্রির পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই বিদেশীদের বিক্রি করে দেয়া শেয়ার কিনে নিয়েছেন। সর্বশেষ অক্টোবরের শেষের হিসাব অনুযায়ী, ২২৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ হাজার ৫১২ জন ব্যক্তির কাছে প্রতিষ্ঠানটির ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শরীফুল আলা যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের স্নাতক। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের সদস্য। যুক্তরাজ্যে তিনি পিডব্লিউসিতে চাকরি করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং তার পরিবারের সদস্যরাও সেখানে থাকেন। কারণেই হয়তো পরিবারকে সময় দিতে তিনি এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কারণ জানতে কিউএম শরীফুল আলার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

১৯৯৭ সালে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক (অর্থ) পদ থেকে ডিবিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ডিবিএইচ ছাড়াও তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও তিনি এমজেএল বাংলাদেশ, ওমেরা ফুয়েলস, ওমেরা পেট্রোলিয়াম, ইউনিক্যাপ সিকিউরিটিজ ওমেরা সিলিন্ডারের পর্ষদেও ছিলেন।

এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিএইচের কোম্পানি সচিব জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনেকদিন ধরেই আমাদের শেয়ার ধরে রেখেছিলেন। এমনকি তারা স্টক লভ্যাংশও নিয়েছেন। আকর্ষণীয় মূলধনি মুনাফা পাওয়ার কারণে তারা শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নিয়েছেন। তাছাড়া সে সময় এমনিতেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা চলছিল।

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ডিবিএইচের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার ৮৭৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ঋণ অগ্রিমের পরিমাণ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির আমানতের পরিমাণ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ডিবিএইচের কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৮২ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ডিবিএইচের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ছিল দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন