গ্রামের উপরে পরিবর্তন হয়েছে, বদলাতে হবে ভেতরটাও

সৈয়দ আবুল মকসুদ

১. আমার মনে আছে, আমাদের এলাকায় ঝিটকা বাজারে প্রথম আটার কল স্থাপতি হয় ১৯৫৫ সালে। সম্ভবত শিবালয় ও হরিরায়পুর উপজেলার একমাত্র আটার কল। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লঞ্চ কোম্পানির বেঙ্গল ওয়াটার ওয়েজের মালিক। প্রবল উৎসাহে আমাদের কাজের লোকের সঙ্গে গম নিয়ে আটা করতে গিয়ে অবাক হলাম। আট-দশ সের (কেজি) গম কয়েক মিনিটেই ভাঙানো হয়ে গেল। ওই ১০ সের গম আগে যাঁতায় ভাঙাতে কাজের মেয়েদের দু-তিন দিন লাগত। তাছাড়া যাতায় গম পেষা অতি কষ্টসাধ্য কাজ। তাতে আটাও অত মিহি হয় না।

২ কিছুদিন পর স্থাপিত হলো চালকল। কলে ধান ভাঙিয়ে চাল করার আগে ঢেঁকিতে করা হতো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম ছিল না যার কোনো না কোনো বাড়ি থেকে ঢেঁকিতে ধান-গম ভানার আওয়াজ পাওয়া যেত না। সেকালে বাঙালির মধ্যে রুটি খাওয়ার অভ্যাস বিশেষ ছিল না। গরিব শ্রেণীর মানুষ ‘গমের ভাত’ খেত। তাছাড়া যবের ছাতুও হতো ঢেঁকিতে। 

একসময় ধনী-গরিব অনেকের বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল। শুধু ধান, গম ভানতে নয়, পিঠা বাঙালির অতি প্রিয়, পিঠার গুঁড়িও ঢেঁকিতে করা হতো। ঢেঁকির শব্দে এক ধরনের ছন্দ ও মদিরতা ছিল। বাংলার গ্রামে আজ ঘুঘুর ডাক যদিও শোনা যায়, ঢেঁকির শব্দ একেবারেই নেই।

৩. গত ৫০-৬০ বছরে বাংলার গ্রামীণ জীবনে যে পরিবর্তন ঘটেছে, মাত্রা ও গুণগত বিবেচনায় পূর্ববর্তী কয়েকশ বছরে তা হয়নি। বিশেষ করে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে রূপান্তর ঘটেছে অতি দ্রুত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক পর্যন্ত গ্রামের ৬০-৭০ ভাগ মানুষের বাড়িতে ছিল ছনের ঘর, নয়তো টিনের ছাপরা। এখন ছনের ঘর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রায় সব মানুষের বাড়িতে একটি টিনের ঘর। অনেকের বাড়ি সেমিপাকা। বহু গ্রামেই এখন দু-একটি দোতলা বাড়ি।

একটি জায়গার আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র সেখানকার মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদে পাওয়া যায়। এখনকার প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। ৫০-৬০ বছর আগে আমাদের গ্রামগুলোর ৯০ ভাগ মানুষ থাকত খালি পায়ে। সেকালে সস্তা জুতা ছিল রবারের তৈরি। তার দাম ছিল তিন-চার বা পাঁচ-ছয় টাকা। সেই রবারের একজোড়া জুতাও ছিল খুব কম মানুষের। ষাটের দশকের প্রথম দিকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল বের হয়। তখন তার দাম ছিল দু-আড়াই টাকা। সেই স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে অল্প মানুষেরই। 

গ্রামের অর্ধেক মানুষের পরিধেয় বস্ত্রের মধ্যে ছিল লুঙ্গি-গেঞ্জি। খুব অল্প লোকের একটির বেশি জামা ছিল না। সে জামার ছিল তিনটি পকেট। প্রতি বছর একটি জামা কিনেছে এমন মানুষ ছিল খুবই কম। একটি শার্টই কয়েক বছর পরত। এখন ছেঁড়া জামা সেলাই করে কেউ পরে না। তখন শুধু সেলাই নয়, তালি দিয়েও পরত। এখনো গ্রামের মানুষ লুঙ্গি-জুতাই পরে, তবে ছেঁড়া কাপড় পরতে দেখা যায় না। অল্প বয়স্ক সবাই পরে শার্ট-প্যান্ট, অথবা নানা রকম কথা লেখা বাহারি গেঞ্জি। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে এক গ্রামে দু-একটি বাড়িতে ছিল এক ব্যান্ডের একটি সিটিজেন ট্রান্সমিটার, তাতে স্বাধীন বাংলা বেতার বা বিবিসির খবর শোনার জন্য মানুষ সন্ধ্যার পরে ভিড় করত। আশির দশক থেকে দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসে। গ্রামীণ দারিদ্র্যও কমতে শুরু করে। বর্তমানে গ্রামের অনেক বাড়িতেই রঙিন টেলিভিশন। পল্লীতে বিদ্যুৎ গেছে, যদিও তা নিরবচ্ছিন্ন থাকে না সারা দিন। তা সত্ত্বেও বিদ্যুতের কারণে অনেক বাড়িতে ফ্রিজও আছে।

রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন গ্রামের মানুষকে বিশ্বের মধ্যে যুক্ত করেছে। দুনিয়ার কোন প্রান্তে কী হচ্ছে তা তাত্ক্ষণিকভাবে মানুষ প্রত্যন্ত পল্লীতে থেকেও জানতে পারছে। তার ফলে সে যে শুধু অজ্ঞ থাকছে না তা নয়, তার চেতনার মান বাড়ছে। দেশ-বিদেশের রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তার ধারণা জন্মাচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও যে মতামত দিতে পারেন এবং দেশের নেতারা যখন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবর্তা বলেন, তা গ্রামের মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।

গ্রামের মানুষ এখন ঘরে বসে আন্তর্জাতিক খেলাধুলা দেখছে টিভিতে। ক্রিকেটে কোন দল জিতবে, কোন দল হারবে তা নিয়ে বাজি ধরে। দেশ-বিদেশের নাটক-চলচ্চিত্র উপভোগ করছে পল্লীবাসী। তাতে অবশ্য লাভ-ক্ষতি দুই-ই হচ্ছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ কমছে। বিদেশী সংস্কৃতির ক্ষতিকর উপাদান গ্রামের মানুষের জীবনেও প্রবেশ করছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণপরিবহনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পঞ্চাস ও ষাটের দশকে মফস্বলের কাঁচা রাস্তায় কোথাও একটা জিপ গাড়ি দেখা গেলে ছেলেমেয়েরা সেটা দেখার জন্য ছুটে যেত। এখনকার জেলাগুলো তখন ছিল মহকুমা। সেই মহকুমা প্রশাসক এসডিওর ছিল উইলি জিপ। সেই জিপ হাঁকিয়ে তিনি যখন কোনো গ্রামে যেতেন সেই গাড়ির দিকে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। এখন এলজিইডি গ্রামের প্রায় সব রাস্তাই যানবহন চলার উপযোগী করেছে। তাতে সারাদিন অত্যাধুনিক মোটরযান থেকে নসিমন, করিমন, ভটভটি প্রভৃতি চলাচল করছে। সারা বাংলাদেশ এখন ছেয়ে গেছে ব্যাটারিচালিত আটোরিকশায়। গ্রামের মানুষের যাতায়াতে একসময় দুটি পা-ই ছিল প্রধান অবলম্বন। এখন মানুষ হাঁটতে চায় না। এক কিলোমিটারও যায় ইজিবাইক অথবা রিকশায়। তা যেতে পারছে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে।

আগে গ্রামের মানুষ ছিল আধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। গরিব মানুষ তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করত। এখন আর তা করে না। এখন অসুখবিসুখ হলে যায় হয় গ্রামের বাজারের ডিসপেনসারিতে কোনো ডাক্তারের কাছে, নয়তো উপজেলা সদর হাসপাতালে। তবে এখনো সরকারি চিকিৎসাসেবা গ্রামের খুব কম মানুষই পায়। উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো ভালো হতে পারত, কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি এবং একশ্রেণীর ডাক্তারদের হাসপাতালে অনুপস্থিতির কারণে গ্রামের গরিব ও কম আয়ের মানুষ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। 

গ্রামীণ জীবনে রূপান্তর ঘটেছে কতভাবে। আগে গ্রামের আশি ভাগ পরিবার ব্যবহার করত নদী ও পুুকুরের পানি। এখন প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নলকূপ। স্থানীয় সরকার থেকে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে টিউবওয়েল দেয়া হয়েছে। তাতে পানিবাহিত রোগ যেমন আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড প্রভৃতিতে আগে যে প্রাণহানি ঘটত বহু মানুষের, এখন তা হয় না। 

হাজার বছরের বাংলার যে সমৃদ্ধ কৃষি সভ্যতা গড়ে উঠেছে তা প্রধানত গ্রামকে কেন্দ্র করে। বাংলার যে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি তা প্রধানমত গ্রামীণ সংস্কৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির অনেক বৈশিষ্ট্যই হারিয়ে যাচ্ছে। তাতে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। বাঙালির লোকনাটক বা যাত্রাশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তাতে জীবিকা হরাচ্ছেন অনেক দক্ষ যাত্রাশিল্পী। গ্রামে কুটিরশিল্পী, মৃিশল্পীরাও জীবিকার সংকটে।

অন্যদিকে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতায় গ্রামের মানুষও পিছিয়ে নেই। গ্রামের মেয়েরা সাইকেল চালায়। পুরুষচালিত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যাতায়ত করে নারী। মেয়েরা শুধু ব্যাটমিন্টন নয় ফুটবল পর্যন্ত খেলছে। রক্ষণশীল গোত্র যে রক্ষচক্ষু দেখায় না, তা নয়। কিন্তু তাদের থেকে আসা বাধাটা অতীতের মতো আক্রমণাত্মক নয়, কারণ রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির জোর কম।

গত ৫০ বছরে বাংলার গ্রামের যে রূপান্তর ঘটেছে তা তার বহিরঙ্গে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে প্রায় প্রতিটি এলাকায়। মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে উঠছে ছেলেদের সঙ্গে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছে। পল্লীর মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এসবই ইতিবাচক পরিবর্তন। এর জন্য সরকারের কৃতিত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর ভূমিকাও অসামান্য।

সমাজ থেকে অনেক কুসংস্কার দূর হয়েছে, কিন্তু ধর্মান্ধতা দূর হয়েছে, তা বলা যাবে না। পীর-ফকিরের আস্তানা যেমন প্রচুর, তেমনি আধুনিকতার প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। অনেক এলাকায় এখন বিউটি পার্লারের ব্যবসা হচ্ছে। পোশাক-পরিচ্ছদে পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যাভ্যাসে পর্যন্ত পরিবর্তন ঘটছে। গ্রামের তরুণ-তরুণীদেরও শুধু রসগোল্লা চমচমে মন ভরে না, ফাস্টফুড চাই। তা যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির তা তারা শুনবে না। নতুন প্রজন্মের কাছে ইংরেজি ও হিন্দি গানের কদর বেড়েছে। বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে লালনগীতি বা পল্লীগীতির চেয়ে, রবীন্দ্র-নজরুলসংগীতের চেয়ে পপসংগীত ও বলিউডের ছয়াছবির নায়ক-নায়িকাদের পরিবেশিত হিন্দি গানই মাইকে বাজানো হয় বেশি। গ্রামের উপরিভাগে যতই পরিবর্তন ঘটুক, অর্থনৈতিক অবস্থা যতই ভালো হোক, মানুষের ভেতরটায় যদি পরিবর্তন না ঘটে, মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে শোচনীয় ঘাটতি থাকে, তাহলে গ্রামের এ উন্নয়ন বা রূপান্তরে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব হবে না। 


সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন