জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি: দুই গ্রামের গল্প

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রামীণ জীবনপ্রণালিতে ব্যাপক গতিপরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনই চারটি গ্রাম এবং তাদের বাসিন্দারের জীবনযাত্রার গল্প তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিনিধিত্বকারী গ্রামগুলোকে মূলত সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলমান বিষয়াবলির নিরিখে বেছে নেয়া হয়েছে। প্রথমত, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ দখল করে আছে বৈদেশিক মুদ্রার আয়। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী বিপুলসংখ্যক প্রবাসী মূলত গ্রাম থেকেই আসেন। দ্বিতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, সেচ ব্যবস্থা ও কীটনাশক ব্যবহার। নানা অঞ্চলে একই জমিতে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। তৃতীয়ত, ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক কারণে বাংলাদেশ বরাবরই প্রাকৃতিক, এমনকি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের হুমকিতে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নদীর ঢেউয়ের উচ্চতা, টর্নেডো, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের মাত্রা বেড়ে গেছে। অনেক মানুষ দেশের ভেতরেই তাদের বাসস্থান বারবার বদলাতে বাধ্য হয়েছে। চতুর্থত, পরিবহন অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। লেনদেনের খরচ কমেছে। পঞ্চমত, এখনো অনেকে পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত অঞ্চল রয়েছে যেখানে ফলন কম হয় এবং উৎপাদিত ফসলের ওপর নির্ভর করে জমির মূল্য নির্ধারিত হয়। ষষ্ঠত, বাংলাদেশ এখনো আদিম ব্যবস্থায় পুঁজি সঞ্চয়নের আদর্শ উদাহরণ। এ প্রবণতা কখনো কখনো বৈশ্বিকভাবেও নিয়ন্ত্রিত।

এক. শ্রীমন্তপুর, কুমিল্লা

রাজধানী ঢাকার পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের খুব কাছেই অবস্থিত কুমিল্লার একটি গ্রাম শ্রীমন্তপুর। এ গ্রামটিকে নির্বাচন করা হয়েছে মূলত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য। ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত ব্যস্ত শহর চান্দিনার খুব কাছে এই শ্রীমন্তপুর। কুমিল্লা থেকে গাড়িতে আধা ঘণ্টার দূরত্ব। কৃষি বিষয়ে ১৯৫৩ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহায়তায় শুরু করা ‘কুমিল্লা মডেলে’ যুক্ত থাকায় শ্রীমন্তপুর নামটি পরিচিত। পাকিস্তান একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট (১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট নামকরণ করা হয়) কর্তৃক গৃহীত গ্রাম উনয়নের একটি প্রকল্প ‘কুমিল্লা মডেল’। কুমিল্লা শহরের ঠিক বাইরেই এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আখতার হামিদ খানের হাতে এ মডেলটি শুরু হয়।

এই গ্রামের কৃষকরা উর্বর ভূমির পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে তুলনামূলক উচ্চফলনশীলতা উপভোগ করেন। অন্যান্য গ্রামের সাথে এ গ্রামের উৎপাদনশীলতা বিচার করলে বেশকিছু বিষয় এবং আলাদা গুণাগুণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, অনান্য অনেক এলাকার কৃষকদের চেয়ে এ গ্রামের কৃষকরা বাইরের বাজারের সঙ্গে বেশি সংযুক্ত। শহরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগের উপায় থাকার কারণে বিনিময়ের ক্ষেত্রে এ গ্রামের কৃষকরা সুবিধা লাভ করেন। চান্দিনার কাছেই অবস্থিত নিমসার বাজার বাংলাদেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার। এখানে এসে কৃষকরা তাদের পণ্য কোনো মধ্যস্বত্বভোগী বা সরাসরি ঢাকা কিংবা কুমিল্লা থেকে আসা পাইকারের কাছে বিক্রি করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, বর্ষার আগে বা পরের বন্যা থেকেও এ গ্রাম মুক্ত থাকে। এ দুর্বিপাক অন্যান্য অনেক অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করে। জালবায়ু, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে গ্রামটি সহজেই সেচ ব্যবস্থার সুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে দেশের যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে গ্রামটি অনেক বেশি কৃষিবান্ধব। বেশির ভাগ অংশই উচ্চভূমি। সময় অনুসারে আমন ও বোরো ধান উৎপাদন হয়। দেশের অন্যান্য নিচু অঞ্চলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কৃষকরা নিজের পছন্দ অনুসারে যেকোনো বিকল্প সফল ফলানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অনেক কৃষক ধান উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি এবং বাজারে বিক্রি করার জন্য অন্যান্য অর্থকরী ফসল ফলিয়ে থাকেন। এভাবে তারা তাদের উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনেছেন। কেবল উৎপাদনই করছেন না, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল উদ্বৃত্তও থাকছে। 

তৃতীয়ত, কৃষকরা লক্ষ করছেন, প্রচুর ফলনের দরুন তাদের ফসলি জমি দিন দিন উর্বর থেকে অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে উৎপাদন সমান রাখা কিংবা বাড়ানোর চেষ্টা করা। বেশির ভাগ জমিই তিন ফসলি হলেও কৃষকরা ওই জমিতে বছরে চারবার ফলন তোলার চেষ্টা করেন।

চতুর্থত, জনপ্রতি জমির পরিমাণ এখানে খুব কম। গড়পড়তা ভূমিখণ্ডগুলো ছোট আকারের। জ্যেষ্ঠ প্রজন্ম থেকে কনিষ্ঠ প্রজন্মে উত্তরাধিকার যাওয়ার মাধ্যমে জমিগুলো ক্রমাগত খণ্ডিত হচ্ছে; একর বা পাখি থেকে মূল জমির ভগ্নাংশ হয়ে শতাংশ, গণ্ডা এবং বিঘায় পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমির মাপ তুলনামূলক জটিল। অঞ্চলভেদে এ হিসাবেও কিছু পার্থক্য হয়। সাধারণত এক একর=১০০ শতাংশ; ৩৩ শতাংশ =এক বিঘা; ছয় শতাংশ =এক গণ্ডা। জমি ভাগাভাগির এই দৃশ্য অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এ গ্রামে বেশি। ক্রমাগত একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে, যেসব অঞ্চলে উৎপাদনের হার উচ্চ সেখানে জমি ভাগের ঘটনাও বেশি।

পঞ্চমত, বন্ধকি বা বর্গা নেয়ার মাধ্যমে জমিতে লেনদেনের পাশাপাশি জমি ক্রয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিস্তীর্ণ ভূমির মালিক কিংবা জোতদার শ্রেণী মূলত পরিবারসহ শহরবাস বা অন্য অনেক কারণে ভূমিহীন ও স্বল্প ভূমির অধিকারীদের কাছে জমি বর্গা দিয়ে চাষ করান। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলের রীতি ভিন্ন। এখানে ভূমি মালিকদের একটি বড় অংশ নিজেরাই তাদের কর্ম ও শক্তি সম্পূর্ণ নিয়োজিত করার বিনিময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন বা মুনাফা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। গ্রামবাসী বলছে, এ দুই ধরনের জমির মালিকদের মধ্যে মূল পার্থক্য শিক্ষায়। তুলনামূলক শিক্ষিত গোষ্ঠী তাদের জমি বর্গা দিয়ে ফসলের ভাগ নিয়ে থাকেন। আর কম শিক্ষিত গোষ্ঠীটি কথিত ‘খাঁটি চাষী’ হয়ে থেকে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প দেখেন না।

জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

কুমিল্লার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কম। তবে জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়েও জাতীয় পর্যায়ে ঘনত্বের চেয়ে এ অঞ্চলে ঘনত্ব বেশি। এ কারণেই জমি ভাগ হওয়ার সমস্যাটি অন্যান্য গ্রামের চেয়ে এখানে বেশি। পরিবার যত বড় হচ্ছে জমি তত ভাগ হয়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমি খণ্ডিত হওয়ার কারণে বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষকরা অধিক ফসল ফলাতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রামবাসীর ভাষায়, ‘এখানে কৃষকরা তাদের জমিকে এক মুহূর্তের জন্য ফেলে রাখেন না।’ যেকোনো আকারের জমিই হোক না কেন কৃষকরা তিন-চার দফা ফসল ফলাচ্ছেন। এ গ্রামে চাষযোগ্য জমির মধ্যে অধিকাংশই দ্বিফসলি বা ত্রিফসলি। এ কারণে এখানে বাংলাদেশের জমির স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা ছাপিয়ে গেছে। এখানকার পরিবেশ ধানের পাশাপাশি ভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষে সহায়ক।

ভূমি সম্পর্ক

গ্রাম পর্যায়ের শুমারি থেকে লক্ষ করা গেছে, ভূমির অধিকার এবং ভূমিতে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য আছে। ক্ষুদ্র খামারিরা গড়ে আধা একর জমির মালিক, কিন্তু তারা এক একরের বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ করেন। মধ্যম পর্যায়ের জমির খামারিরা তাদের জমির পরিমাণের দ্বিগুণ জমি চাষ করেন। উল্টো করে ভাবলে বড় খামারিরা তাদের জমি ছোট এবং মাঝারি খামারিদের চাষ করতে দেন। অদ্ভুত বিষয়টি হলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ গ্রামে জমি বর্গা দেয়ার পরিমাণ কম, কেননা নিজের জমি থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। একটি বিষয় স্পষ্ট, ছোট কৃষকদের কাছে জমি কম দেয়ার কারণ চাষের শুরুতে যে মূলধন ব্যয় করতে হয় তা জোগাড় করা মাঝারি কৃষকদের তুলনায় ছোট কৃষকদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। জমিতে কাজ করার ক্ষেত্রে জমির দখল, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা এবং কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে চুক্তিতেও আসতে হয়। কখনো কখনো সরকারি ব্যবস্থাপনায় সার বিতরণ করা হয়। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশের এ অংশে ভূমিহীনতা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বর্ধনশীল। তবু এ কথা মনে রাখতে হবে, এখানে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও অনেকেই বর্গাচাষী এবং তারা ফসলের ভাগ লাভ করেন। জমি অধিকারের পাশাপাশি চিত্রটি জাতীয় কৃষিশুমারির রেকর্ড করা চিত্রের সাথে মিলে যায়। 

অধিকারে রাখা কিংবা চাষযোগ্য জমির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। শহরের খুব কাছে এবং রাজধানী থেকে দূরত্ব কম হওয়ার কারণে অনেক শিল্প-কারখানা এমনকি পোলট্রি ফার্মও কুমিল্লায় স্থাপিত হচ্ছে। শিল্প-কারখানাগুলো জমি অধিকার করার কারণে এখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে জমি খণ্ডিত হওয়ার বিষয়টি সর্বব্যাপী চিত্রে পরিণত হয়েছে। 

ছোট চাষী ও ভাগচাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মধ্যম ও বড় খামারিদের সংখ্যা কমেছে। জমির অধিকার ও গার্হস্থ্যের ক্ষেত্রে কুমিল্লা অঞ্চলে জাতীয় গড়ের তুলনায় ছোট চাষীদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম পর্যায়ের শুমারিতেও এ একই ঘটনা লক্ষ করা গেছে। বেশির ভাগ জমির অধিকারী প্রত্যন্ত অথবা ক্ষুদ্র খামারি। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এখানকার জমির আকার ছোট।

শুমারির উপাত্ত আরো দেখায় যে জমি বর্গা দেয়া এবং বন্ধকির ক্ষেত্রেও একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। ভাগ চাষ কমে গেছে। ভাগে চাষের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই সব ধরনের শ্রম দিতে হয়। এখন উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চাষীরা মরিয়া। জমির মূল মালিক জমি লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত মূল্য প্রদান (দাদন) ব্যতীত কোনো রকম সাহায্য করতে নারাজ। লিজের ক্ষেত্রে তাই চাষী উচ্চমাত্রায় উৎপাদন করতে বাধ্য হয়। উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট থাকে। এ বাধ্যবাধকতার কারণেই চাষীরা অধিক ফসল ফলাতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে জমির উর্বরা শক্তি কমিয়ে ফেলছেন। এ রকম জবরদস্তির কারণে কৃষকরা ঋণেও জড়িয়ে পড়েন। ক্ষুদ্র খামারিরা এ সময়ে বড় জোতদারদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। পর্যাপ্ত উৎপাদন না হলে যেকোনো উপায়ে ঋণ শোধ করতে হয়। তখন তারা এনজিও বা অন্য উপায় থেকে ধার করে। স্থানীয় তেজারতি কারবারিদের সুদের হার এনজিওর চেয়ে বেশি হলেও ঋণ পরিশোধের মেয়াদের ক্ষেত্রে তারা এনজিওর চেয়ে নমনীয়।

উৎপাদন প্রক্রিয়া

বীজ, পানি ও প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার বাড়ছে। বেশির ভাগ কৃষকই চান্দিনা শহর থেকে বীজ ক্রয় করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও সর্বত্রই তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে এবং বীজ বিতরণে তারাই অগ্রগামী। গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা ক্ষেতে সেচ দেয়া হয়। বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। রাসায়নিক সারের ব্যবহার বহুল বিস্তৃত হয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। গ্রামবাসীই নিশ্চিত করেছে, বিগত সময়ের চেয়ে সারের ব্যবহার প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমছে।

কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি এবং অন্যান্য অনুসঙ্গ ব্যবহারে প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষুদ্র খামারিরা এগিয়ে। ছোট কৃষকদের নিজেদের না থাকলেও তারা ভাড়া করে এসব ব্যবহার করেন। গভীর নলকূপগুলো এজমালি হিসেবে স্থাপিত ও ব্যবহূত হয়। কৃষি সম্পর্কিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি সাধারণত ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং কখনো কখনো তা ভাড়া দেয়া হয়। অগভীর নলকূপগুলোও ভাড়া দেয়া হয় এবং মিটার অনুসারে ব্যবহূত বিদ্যুতের খরচ প্রদান করতে হয়। এছাড়া অন্যান্য ছোটখাটো যন্ত্রপাতি কৃষকদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন থাকে এবং ক্ষুদ্র কৃষকরা কখনো কখনো অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য এসব ভাড়াও দিয়ে থাকেন। গরু বা বলদ দিয়ে হালচাষের বদলে এখন ট্রাক্টর ব্যবহূত হচ্ছে।

বেশির ভাগ কৃষকই আগের গোবর সার বাদ দিয়ে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। রাসায়নিক সারের এ অতিরিক্ত ব্যবহারই জমির উর্বরা মক্তি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে জমি টুকরো হয়ে যাওয়ার কারণেও জমিতে ফসল ফলিয়ে তা বিক্রি করে অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে অতিরিক্ত ফসল ফলাতে বাধ্য হচ্ছেন। জমির আকার যা-ই হোক না কেন, কৃষকরা সব ধরনের প্রযুক্তি বা উপায় ব্যবহার করে বছরে তিন-চার দফা ফসল ফলাতে সচেষ্ট।

বিনিময় প্রক্রিয়া

এখানকার কৃষকরা বিচিত্র উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। বেশির ভাগ কৃষক এখন ধানের পাশাপাশি আলু, টমেটো, কুমড়া ও মাছ চাষ করে এখানকার বাজারে বিক্রি করছেন। তারা জমি পতিত রাখছেন না। 

যতদিন বাজারে ফসলের উপযুক্ত চাহিদা তৈরি না হয় ততদিন হিমাগারে ফসল সংরক্ষণের মাধ্যমে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন। চালকলের মতো হিমাগারগুলোও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে থাকে। এরা হিমাগারের খরচ হিসেবে কৃষকের লাভের একটা বড় অংশ নিয়ে নেয়। এ অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় কৃষকরা সরাসরি বাজারে পণ্য পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। এ কারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে তারা ছাড়ও পেয়েছেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্য দুর্গম অঞ্চলে নিজেদের পরিধি বিস্তৃত করছেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা নিজেদের চতুরতা এবং প্রভাবের কারণে বিনিময় ব্যবস্থায় একটা বড় প্রভাব রাখেন। এরা মূলত ক্ষুদ্র জোতদারদের সাথে চুক্তি করেন। কারণ ক্ষুদ্র কৃষকের যথেষ্ট লোকবল থাকে না এবং তারা কেবল মাঠে উৎপাদনের মধ্যেই নিজেদের ব্যস্ত রাখেন; এর বাইরে বেশি কিছু জানেনও না, বোঝেনও না। বড় জোতদাররা মূলত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিংবা তাদের পরিবারের কেউ শহরে ভালো কাজ করেন অথবা বিদেশে অবস্থান করেন। সেখান থেকে নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করে থাকেন।

ভূমি বিক্রি, ক্ষমতা এবং রাজনীতি

কোনো বড় অসুখ হলে বা ভুল বিনিয়োগে ক্ষতি হলে কিংবা যৌতুকের অর্থ জোগানের জন্যই কৃষককে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ অর্থাৎ জমি বিক্রি করতে হয়। কৃষকরা নতুন বিনিয়োগ, যেমন পরিবারের কোনো সদস্যকে বিদেশে প্রেরণের জন্য তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন বা বাধ্য করা হয়। তারা মনে করেন নতুন বিনিয়োগ তাদের জন্য লাভজনক হবে। আবার এ ভূমি নতুন করে কিনবেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রামে যারা নতুন করে জমি কিনছেন তারা বেশির ভাগই শহর বা বিদেশে থাকা সদস্যদের প্রেরিত অর্থেই কিনছেন।

ভূমি অধিকারের সাথে ক্ষমতার যোগ বাংলাদেশে একটি পুরনো বিষয়, এ গ্রামটিও ব্যতিক্রম নয়। যার যত বেশি জমি, সে তত বেশি ক্ষমতাবান। অবস্থা বোঝাতে ধরা যাক, ‘ক’ ও ‘খ’ একটি দাম নির্ধারণ করে সেই দামে জমি কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এমন সময় জমি বিক্রির কথা জেনে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ‘গ’ সেখানে এসে উপস্থিত হলো এবং বলল এই জমি সে কিনতে চায়। যেহেতু ‘গ’ একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তাই সে নির্ধারিত দামের কম দাম বললেও তার কাছেই জমি বিক্রি করা হয়। অবশ্য কখনো কখনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি নির্ধারিত মূল্যের বেশিও প্রস্তাব করতে পারেন, যাতে বিক্রেতা অবশ্যই তার কাছে জমি বিক্রয় করেন। মানুষকে ক্ষমতাবান তখনই ভাবা হয় যখন তার ক্ষমতাবান আত্মীয় বা ক্ষমতাবান কারো সাথে যোগাযোগ থাকে। কখনো অর্থসম্পদ থাকার কারণে ক্ষমতাবান, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন।

দখলদারিত্ব এই গ্রামে বেশি দেখা যায় না। বেশির ভাগ পরিবার থেকেই কেউ না কেউ শহরবাসী এবং রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সবারই কম-বেশি রয়েছে। তবে প্রতিবেশীদের মধ্যে ছোটখাটো দখল, বেদখলের ঘটনা ঘটেই থাকে। চান্দিনায় ৩০-৪০ শতাংশ লোকজন ক্ষমতা ব্যবহার করে জমি ক্রয় করেন। এখানে বড় উভয় দলেরই ‘আশীর্বাদ’ থাকে। ক্ষমতার প্রদর্শন দলীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট পরিচিত ব্যক্তিরাই এখানে মূল। আসলে উভয় দলের লোকজনই এক্ষেত্রে গোপন মৈত্রীর মাধ্যমে লাভবান হয়।

সারসংক্ষেপ: শ্রীমন্তপুর, কুমিল্লা

কুমিল্লার শ্রীমন্তপুর গ্রাম প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ঢাকা ও কুমিল্লা এ দুই শহরের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে আলাদা। এ দুই শহরের সান্নিধ্য গ্রামটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। এছাড়া অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থান এখানকার উৎপাদন ব্যবস্থা এবং জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করেছে। গ্রামের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হলেও জন্মহার কম। জনসংখ্যার উচ্চঘনত্ব এখানকার জমি ভাগ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ভূমির উর্বরতার কারণে এখানকার মানুষ উচ্চফলনশীলতা উপভোগ করছে। উচ্চফলনশীলতা ছোট ছোট পরিবারগুলোকে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হতে সহায়তা করেছে।

বেশির ভাগই প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র কৃষক। এরা নিজেদের অধিকারে থাকা ভূমির চেয়ে বেশি পরিমাণ ভূমিতে চাষ করে। বড় জমির মালিকদের বহিঃস্থ আয়ের উৎস রয়েছে বলে তারা জমির আয়ের ওপর নির্ভর করেন না। তারা ভূমিহীন বা ছোট চাষীদের কাছে জমি বর্গা দিয়ে থাকেন। যেহেতু উৎপাদন বেশি হয় তাই অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এখানকার জমির মালিকেরা ফলনের ক্ষেত্রে আগ্রহী। তবু এখানেও ভূমিহীনের পরিমাণ বাড়ছে। 

বাজারে যাতায়াতের সহজ সুবিধা থাকার কারণে এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের হিমাগার ব্যবহারের প্রয়োজন তুলনামূলক কম। তবু অন্যান্য গ্রামের মতো এখানেও বাজার ব্যবস্থার সমস্যা দেখা যায়। ক্ষুদ্র খামারিরা অন্যান্য ধনী জোতদারদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। যখন ফসল কম ফলে বা কোনো কারণে পরিমাণমতো ফসল আহরণ না হলে ঋণ শোধ করতে আবার ঋণ নিতে বাধ্য হন। 

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এ গ্রামকে অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বেশি পুঁজি তৈরিতে সাহায্য করেছে। ভূমি বাজারের সঙ্গে যুক্ত বাজারভিত্তিক শোষণ এখানেও লক্ষ করা গেছে। কৃষিকাজ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু পরিমাণ ক্ষমতা থাকা, ক্ষমতার ব্যবহার বা ক্ষমতাবানদের সাহায্য নিতে হয়। ক্ষুদ্র খামারিরা অনেক সময় সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে যায়। এ জমিগুলো আবার বৈদেশিক আয় বা কৃষি খাতের বাইরে থেকে আয় হয় এমন সব পরিবার কিনে নেয়। এ জমির বাজারই আবার বৈদেশিক আয় বা কৃষির বাইরের রোজগারকে গ্রামে আনে। বাজারবহির্ভূত লেনদেন যেমন দমি দখল এখানে প্রচলিত। ধনী বা ক্ষমতাবানরা ধীরে ধীরে প্রতিবেশীর ভূমি গ্রাস করে।

এ গ্রামে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ খুব বেশি ব্যবহূত হয়। পাশাপাশি পানি ও প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। বেশির ভাগ কৃষক রাসায়নিক সার ব্যবহারে এখন দ্বিতীয় প্রজন্ম। রাসায়নিক ব্যবহার ও ফসল অধিক ফলানোর চেষ্টায় ভূমির উর্বরা শক্তি কমে চলেছে। ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে ফসলের ফলন ধরে রাখার বিষয়টি হুমকির মুখে।

দুই. চর লক্ষ্মী, নোয়াখালী

নোয়াখালীর চড় লক্ষ্মী গ্রামটির উত্তর সীমানায় কুমিল্লা জেলা, দক্ষিণে মেঘনার মোহনা এবং বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এর পূর্বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর ও ভোলা অবস্থিত। শ্রীমন্তপুরের তুলনায় চর লক্ষ্মী একদম বিপরীত। এলাকা হিসেবে প্রত্যন্ত ও পশ্চাত্পদ এলাকা। এখানে ফলন কম। প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি এবং ক্ষমতা মিলে এখানে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকের জন্য একটি মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথমত, এ অঞ্চল বারবার ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ইতিহাস থেকেও দেখা যায় নোয়াখালী জেলা বারবারই প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকে। অঞ্চলটি বারবার নদীর স্রোত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউয়ের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে এ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়। ২০০৭ সালে সিডর নামক ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু এবং নিখোঁজ হওয়ার দাবি করা হয়। সাইক্লোন শেলটার নামক মজবুত ইমারতের উপস্থিতি অনুসারে বোঝা যায় কোন এলাকা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। 

দ্বিতীয়ত, অন্যান্য উপকূলীয় কিংবা নদীতীরের মানুষ নদীভাঙনের কবলে পড়ে তাদের ঘর-সংসার নিয়ে এ অঞ্চলে এসে থিতু হয়েছে। আবাস তৈরি করেছে। নদীতে আবার চর জেগে উঠবে—এ ভরসায় তারা কাছাকাছি এলাকাতেই বাস করে। দেশের ভূমি আইন অনুসারেও ৩০ বছরের মধ্যে নদীতে চর জেগে উঠলে নদীভাঙনে জমিহারা মানুষ নতুন জমিতে হিস্যা পায় । যদিও এ জটিল পদ্ধতিতে অনেক সময়েই নানা ঝামেলা সৃষ্টি হয়। নিয়মানুসারে দলিল দেখিয়ে এ জমি ফেরত পাওয়ার কথা, কিন্তু বোশর ভাগ সময় ক্ষমতাবানরাই এসব জমি কব্জা করে।

তৃতীয়ত, এখানকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজে যুক্ত। মাঠ বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকায় বছরের অর্ধেক সময় তারা ধান চাষ করে এবং বাকি অর্ধেক সময় জমি পতিত থাকে। জেলা পর্যায়ের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, খুব অল্প সংখ্যক কৃষক শুকনো মৌসুমে ধান চাষ করতে পারে। এখানে সেচ সুবিধা কম। অর্থাৎ বছরের একটা বড় সময় ধরে উৎপাদনক্ষম এ মাঠ পতিত থাকে। 

চতুর্থত, এ গ্রাম ভাটবাড়ি বাঁধের মাধ্যমে বিভক্ত হয়েছে। বাঁধের মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে যাওয়া গ্রামের দুই ভিন্ন অংশের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কৃষি ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। বাঁধের ভেতরের দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকের কৃষকরা ধান উৎপাদন করে। অনেক সময়েই তাদেরকে বাঁধের অন্য অংশে উৎপাদিত ধানের ওপর নির্ভর করতে হয়। জমির লবণাক্ততার কারণে এ অবস্থা হয়। অনেক সময় কৃষক তার পরিবারের প্রয়োজনীয় ধানও উৎপাদন করতে পারে না। পশ্চিম পাশের ধানের বা উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে অনেক সময় পূর্ব পাশের ফসলের দাম ওঠানামা করে। 

পঞ্চমত, নদী ও ভৌগোলিক অবস্থার ওপর কৃষি উৎপাদন অনেকাংশেই নির্ভর করে। এ অঞ্চলের ভূমি মূলত নাবাল জমি যা বেশকিছু নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং বর্ষাকাল দ্বারা প্রভাবিত। বার্ষিক বৃষ্টিপাত এবং শুকনো মৌসুমের ওপর এ অঞ্চলের উৎপাদন নির্ভর করে। এখানকার মূল নদীগুলোর মধ্যে বামনী এবং মেঘনা প্রধান, যা মূল মেঘনার শাখা। নদীর এ অবস্থিতি ভূমির জন্য যেমন আশীর্বাদ হতে পারে, তেমনি অভিশাপ বয়ে আনতে পারে। খালের পানি লবণাক্ত, যা এ বদ্বীপের ভূমিকেও লবণাক্ত করে চাষের অযোগ্য করে তোলে। নদী থেকে আসা এ লবণের কারণে কৃষক বছরে সর্বোচ্চ দুবার ফসল ফলাতে পারে। কৃষকরা তাই ভারি বর্ষণের ওপর নির্ভর করেন, যা এ লবণাক্ততা ধুয়ে নিতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যার মাত্রা অনুসারে এ নদীগুলো তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। এতে করে একটি বিশেষ ধরনের বাঁক (অক্সবো) তৈরি হয় (বাঁকানো একটা অংশ যা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরও অবশিষ্ট থাকে), যেখানে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী থাকে। এখান থেকেই প্রচুর পরিমাণ মাছ এবং জলজ সম্পদ আহরণ সম্ভব। এমনকি এখানে জমে থাকা মাছ কিংবা অন্যান্য সম্পদ শুকনো মৌসমেও পাওয়া যায় এবং ব্যবহার করা যায়।ষষ্ঠত, বাংলাদেশ ক্রমে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কৃষিও প্রতিনিয়ত নতুন রূপ ধারণ করছে। ব্যবসায়ী এবং বড় খামারিরা এখন বোঝেন যে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিনিয়োগের মাধ্যমে বড় মাপের মুনাফা অর্জন সম্ভব এবং এ কারণে কৃষি এবং জলজ উৎপাদন উন্নত করতে তারা জোর দিচ্ছেন। অন্যান্য যেকোনো মত্স্য ব্যবসার তুলনায় চিংড়ি চাষ এখন প্রচুর জনপ্রিয়। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রফতানিকারক এবং গ্রামাঞ্চলে চিংড়িকে ‘সাদা সোনা’ বলা হয়। সপ্তমত, এখানকার ভূখণ্ড, মানুষ এবং চড় লক্ষ্মীর অবস্থা শ্রীমন্তপুরের চেয়ে আলাদা। একটি মাত্র রাস্তা ধরে এ এলাকায় আসা যায়। রাস্তাটি সরু এবং নোংরা, চারপাশে টিনের তৈরি কিছু দোকানপাট ও স্থাপনা রয়েছে, যা আখতার মিনার হাট নামে পরিচিত এবং অন্যান্য কাছাকাছি অঞ্চলের বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। রাস্তার দুপাশে ধূসর মাঠ দেখা যায়। মাঠে মাঝে মাঝে কিছু পশু ঘুরে বেড়ায় এবং যা পায় তাই তাদের খাদ্য। ক্ষেতের পাশে খাল দেখা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির বদলে এগুলোই সেচের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়। 

জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য 

অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কম। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। জমির উৎপাদনশীলতা কম হওয়া এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানে বসতি কম। এমনকি অনেকে এখান থেকে চলে গেছে। ফলে কুমিল্লার মতো জনবসতি তৈরি হয়নি। জমি লবণাক্ত হওয়া এবং সেচ সমস্যার কারণে অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের চেয়ে এখানকার কৃষকদের অনেক বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। যদিও এখানে মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে, জনসংখ্যার ঘনত্ব জাতীয় গড়ের সমান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ গ্রামের মানুষ তুলনামূলক কম বয়সে বৈবাহিক জীবন শুরু করে। এর কারণ হিসেবে তারা জানায়, জীবনধারণের মতো ফসল উৎপাদনের জন্য বেশি জমি প্রয়োজন এবং শ্রম দেয়ার মতো বেশি মানুষও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা কাজ করলে শ্রমিক খরচের প্রয়োজন হয় না। চর লক্ষ্মীর পরিবারগুলো অন্যান্য গ্রামের পরিবারের তুলনায় বড়। বেশির ভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা নয় কিংবা অধিক, এবং গ্রামে পরিবারের সদস্য সংখ্যার গড় সাড়ে সাতজন। এ গ্রামের মানুষদের রক্ষণশীল মনোভাবও এর একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এ এলাকায় বেশির ভাগ পরিবার রক্ষণশীল মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স নারীদের জন্য ১৮ এবং পুরুষের জন্য ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে বিয়ের জন্য এ নীতি খুব একটা মানা হয় না। অনেক বিবাহিতা নারীর বয়স দৃশ্যতই আঠারোর কম। বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে বিয়ের গড় বয়স কম। নোয়াখালীর চর লক্ষ্মী গ্রাম চট্টগ্রামের অংশ। ১৪-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়ার হার এখানে অনেক। যদিও বাল্যবিয়ে অতি সাধারণ আচার হিসেবে পরিচিত, গ্রামবাসীরা আরো নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। 

ভূমি সম্পর্ক

অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এ গ্রাম আলাদা। গ্রামের ক্ষুদ্র খমারিরা তুলনামূলক বেশি জমির অধিকারী। এখানে ক্ষুদ্র খামারি বা চাষী প্রত্যেকে গড়ে এক-দেড় একর জমি তাদের অধিকারে রাখে। অন্যান্য গ্রামে ক্ষুদ্র খামারিদের অধিকারে থাকা জমির পরিমাণ দেড় একরের বেশি প্রায় কখনই হয় না। জমি খণ্ডিত হওয়ায় মাঝারি এবং বড় খামারের সংখ্যা কমেছে। উপকূলীয় এলাকায় চর অঞ্চলের জমির উল্লেখযোগ্য অংশ মূলত খাসজমি (সরকারি সম্পত্তি)। কিন্তু অধিকাংশই ক্ষমতাসীনদের দখলে। 

উৎপাদন প্রক্রিয়া

অন্যান্য অঞ্চলের মতোই এখানেও প্রধান শস্য ধান। নোয়াখালী জেলায় আমন এবং বোরো উভয় প্রকার ধানই উত্পন্ন হয় কিন্তু চর লক্ষ্মী গ্রামে বোরো হয় না। বোরো মূলত শুকনো মৌসুমের ফসল এবং এ গ্রামে সে পরিমাণ সেচ সুবিধা নেই। বোরো একটি আধুনিক প্রজাতির ধান এবং আমন ঠিক বোরোর মতো বেশি উত্পন্ন হয় না। ধানের পাশাপাশি এখানে চীনাবাদাম, নানা রকম ডাল, মরিচ, আখ এবং আলু উত্পন্ন হয়। এগুলোর চাষাবাদ এখানকার পূর্বের বহুল উৎপাদিত ফসলকে সরিয়ে দিয়েছে বা বলা চলে এক রকম বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এদের মধ্যে তিল, তিসি, পাট, আঞ্চলিক ধান, এবং নানা রকম ডাল রয়েছে। এ পরিবর্তনের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। আঞ্চলিক শিল্প-কারখানার সঙ্গে যোগাযোগের অভাবের কারণে এসব উৎপাদন কমে গেছে, যেমন পাট বা তৈলবীজ।

অন্যান্য এলাকার চেয়ে এ গ্রামে রুজি জোগাড় করা কঠিন। কৃষকের এ দুরবস্থার জন্য কেবল প্রকৃতি দায়ী নয়। প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা, রাজনীতির পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাব এর পেছনে ভূমিকা রাখছে। মোটামুটি সব পর্যায়ের খামারিদেরই পতিত জমি রয়েছে। এমন নয় যে, তারা সেখানে ফসল ফলাতে চান না। কিন্তু কেবল মৌসুম এবং প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে তারা ফসল ফলাতে সক্ষম হন না। 

অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত। সেচের যান্ত্রিক পদ্ধতির অভাব এখানকার কৃষকদের গ্রীষ্মকালে চাষ করতে বাধা দেয়। এখানে যথেষ্ট পরিমাণ খাল নেই এবং গভীর বা অগভীর নলকূপও এখানে যথেষ্ট নয়। আরেকটি অন্যতম সমস্যা জমির লবণাক্ততা। মাটির গভীর থেকে স্বাদু পানি তুলতে দামি যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। নোয়াখালীর গড় সেচ জমি জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। একমাত্র বড় খামারিরাই এ অঞ্চলে এক জমিতে দুবার ফসল ফলাতে পারেন। বড় খামারিদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা আছে।

বিনিময় প্রক্রিয়া

বহু সংখ্যক কৃষককে তাদের ফসল আহরণ করার আগেই তা বিক্রি করে দিতে হয়। দাদন প্রক্রিয়ায় তারা টাকা নিয়ে থাকেন। এ কারণে অনেক সময় ফসল কৃষকের ঘরে আসেও না। তারা কখনো তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে সমর্থ হন না, উল্টো তারা ঘর ছাড়া, ভূমিহীন হয়ে পড়েন। এ অঞ্চলে এ রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। 

চর লক্ষ্মীর বেশিরভাগ চাষী এখানকার আখতার মিয়ার হাটের বাইরে অন্য কোনো বাজারের সঙ্গে পরিচিত না। তবে চিংড়ি ব্যবসায়ী এবং অন্য মত্স্য ব্যবসায়ীরা বাইরের অন্য বাজারের সঙ্গে যুক্ত। নদীপথে তারা সহজেই সেসব জায়গায় যাতায়াত করতে পারেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষকরা যেমন নতুন নতুন বাজারের সঙ্গে পরিচিত হবেন তেমনি বাজারও তাদের খুঁজে নেবে। 

প্রাকৃতিক পরিবেশ যেহেতু উৎপাদনের অনুকূল নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে বাজার ব্যবস্থা আসলে উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। বরং এ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা মূলত বড় বড় ভূস্বামীকে সাহায্য করছে। ক্ষমতা ব্যবহার করে ভূমি দখল এবং অন্যান্য কার্যক্রম এখানকার ছোট ছোট জোতদার, চাষীদের জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন করে ফেলেছে। উন্নত যোগাযোগের কল্যাণে বড় জোতদাররা দ্রুততম সময়ে এবং নিয়মিত তাদের উত্পন্ন ফসল বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ভাগচাষীরা জানায়, ফসল ওঠার সময় তাদের খালি জমিতে বড় বড় ট্রাক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। উত্পন্ন ফসল বাইরে নিয়ে যায়। 

ভূমি বিক্রি, ক্ষমতা এবং রাজনীতি

এখানে ভূমি বিনিময়ও একটা নির্দিষ্ট সময়ে হয়। সাধারণত শুকনো মৌসুমে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে জমি বিক্রি হয়। এ সময়ে কেউ কেউ হতাশ হয়ে বা অন্য কোনো প্রয়োজনে জমি বিক্রি করে। চর লক্ষ্মীতে বৈধ এবং অবৈধ উভয় প্রক্রিয়াতেই মাঝে মাঝে জমি হাত বদল হয়ে থাকে। বেশির ভাগ জমিই খাস বা সরকারের অধীন বলে তা আসলে বিক্রি অসম্ভব। দখলের পরিবর্তন ঘটে। জমি শুধু ভূমিহীন কিংবা ছোট কৃষকের হাত থেকে বড় কৃষকের হাতে যায় এমন না, বড় বড় ভূস্বামীর মধ্যেও হাতবদল হয়। রাজনৈতিক আনুগত্য যে পক্ষে বা দলেই থাকুক না কেন, ক্ষমতাসীনরা সবাই মিলেমিশেই জমি দখল করে। 

জমি বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান এখানকার ক্ষমতাসীনদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের সুবিধার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছে। ভূমির একটি নকশা তৈরি করে। সবকিছুই দালিলিক, কারো কাছে দলিল থাকুক আর না থাকুক। ঘুষ দিয়ে জাল নথি তৈরি হয়। জমি বন্দোবস্ত রেকর্ড এবং রাজস্বের সঙ্গে জড়িত কর্মচারীরা দুর্নীতি করে এবং এ দুর্নীতি নিয়ে জনগণ খোলাখুলি কথা বলে। বিষয়টা এতই স্পষ্ট, এ নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই। ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঘুষ গ্রহণ এবং রাজনীতিবিদদের এ ধরনের আচরণ খুবই পরিচিত। এখানকার ভূস্বামী, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মচারী, বিচার ব্যবস্থাসহ সব পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক জোট রয়েছে। এরা জমি কেনাবেচা এবং অন্যান্য লেনদেনের ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করে। তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করে।

আরেকটি উল্লেখ্য বিষয়, নোয়াখালী অঞ্চল দেশের অনেক প্রথম সারির ব্যবসায়ীর আদি নিবাস। জমি বিক্রি না করলে অনেক সময়েই জমি দখল করে নেয়া হয়। জমি জবরদখল হোক বা না হোক তা মূলত বাঁধের ভেতরের দিকে নেয়া হয়। বাঁধের বাইরের দিকের জমি নেয়া সম্পর্কে জানতে গিয়ে যা শোনা যায়, তাকে ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। এক্ষেত্রে জলদস্যু, সন্ত্রাসী দল এবং ডাকাত খুবই প্রচলিত উদাহরণ। জমিহারা কৃষকরা দিনমজুর কিংবা জেলেতে পরিণত হন।

বাঁধের বাইরের অঞ্চলে, পশ্চিম দিকে মাছ ধরাই প্রধান কাজ। মাছ ধরে সাধারণত অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হয়। এ অঞ্চলকে ‘বঞ্চিত’ বলে ধরা যায়।

যদিও বাঁধের অন্য অংশে মাছ চাষ করা হয় এবং সেজন্য অনেক জমি দখল করে মাছ চাষের ‘প্রজেক্ট’ তৈরি করা হয়েছে কিন্তু সত্যি বলতে এগুলোর বেশিরভাগই কাজ শুরু করেনি। সূত্র থেকে জানা যায় মাছ চাষজনিত কাজে এখানে আগ্রহ তৈরি হলেও আসলে এর প্রয়োজনীয়তা বা প্রকৃত অবস্থা তারা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ভূমিদস্যুরা এ মাছ চাষের অজুহাত দিয়ে প্রভূত ভূমি দখল করে। মূলত ভূমি দখলই তাদের লক্ষ্য। অন্যভাবে বলা যায়, বিস্তৃত পতিত ভূমি দখল করার জন্য সরকারের কাছে ‘প্রজেক্ট’ উপস্থাপন করে সহজে এবং ‘বৈধ’ উপায়ে ভূমি দখল করা যায়। জমি দখলের পর সেখানে সবাই উৎপাদন করে না। 

অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে বাঁধের বাইরে বেশির ভাগই ‘খাসজমি’। মূলত ‘খাসজমি’, ‘নতুন জমি’ নিয়েই বেশি বিতর্ক হয়, সে তুলনায় বাঁধের ভেতরকার জমি নিয়ে বিতর্ক কম। স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে অসংখ্য বক্তব্য পাওয়া গেছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মোটামুটি সব মানচিত্র, স্ট্যাম্প, দলিল এখানকার ক্ষমতাবান লোকদের দ্বারা তৈরি। স্পষ্টই বোঝা যায়, এ ক্ষমতাবানরা এখানকার ক্ষমতাহীন লোকদের উত্খাতের চেষ্টা করছে।

সারসংক্ষেপ: চর লক্ষ্মী, নোয়াখালী

নোয়াখালীর চর লক্ষ্মী দুর্বল ভৌগোলিক অবস্থানে প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা গ্রাম। অল্প সংখ্যক কৃষক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করেন এবং কেবল বড় খামারিরাই উপযুক্ত সেচ এবং অন্যান্য ব্যবস্থার কল্যাণে বছরে দুবার ফসল ফলাতে পারেন। বাঁধ দেয়ার ফলে মাটির লবণাক্ততার মাত্রা বদলেছে। যদিও সবুজ বিপ্লবের ফলে অনেক ছোট চাষী তাদের জমি আরো কিছুদিন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তবে বড় জোতদাররা অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকার কারণে লাভবান হয়েছেন এবং তারা ফলন অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি সর্বোচ্চ দামে বিক্রিও করেছেন। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থার কারণেই তারা এ সুবিধা লাভ করেছেন। 

চর লক্ষ্মী জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যাপ্রবণ। এ কারণে উৎপাদন ক্ষমতা কম এবং অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের তুলনায় অধিক পরিমাণ জমি এখানে চাষ করতে হয়। ক্ষুদ্র খামারিরা বেশি। কিন্তু দুর্যোগের কারণে সম্পূর্ণ জমিতে চাষাবাদ করতে পারেন না। নদীভাঙনের কারণে ভূমি থেকে মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার পরিমাণও এ গ্রামে বেশি। যদিও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ২৪ বছরের মধ্যে এ হারানো জমি পাওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা এবং বাধাবিপত্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক ও ক্ষমতাবানদের দাপটের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে তা সম্ভব হয় না। ক্ষুদ্র কৃষকরা এমনকি ভূমিহীন হয়ে যায়। গ্রামটির অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে হওয়ার কারণে আশপাশে কোনো বড় বাজার না থাকায় বাজার ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশেষত অনেক সময়ে ফসল ওঠার আগেই কৃষকদের ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। এভাবেই তারা চাষের জন্য ব্যয় করা অর্থ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করে। এসব কারণে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অনেক সময় কৃষক ভূমিহীন হয়ে যায়। 

জোর-জবরদস্তির পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখানে নানা কারণে বেশ জোরদার। প্রথমত, যোগাযোগ ব্যবস্থার চলমান উন্নতি হওয়ার কারণে বড় ব্যবসায়ী আরো জমি দখল করে নিচ্ছে। বড় বড় জোতদার জমি লিজ নিয়ে কিংবা দখল করে জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকে। তারা নতুন কোনো ‘প্রজেক্ট’ প্রস্তাব করে ‘বৈধ’ উপায়ে সরকারের কাছ থেকে এ জমির অধিকার নিয়ে নেয়। রেকর্ড, নিবন্ধন, রাজস্ব ইত্যাদির সঙ্গে জড়িতরা ঘুষ ও দুর্নীতিতে এতটাই ডুবে গেছেন যে, অনেক সময়েই তারা ক্ষমতাবানদের হয়ে কাজ করেন। জালিয়াতির মাধ্যমে জমির মালিকানা বদলে যায়। 

(অভিসন্দর্ভের একটি অধ্যায়ের অংশ বিশেষের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন মাহমুদুর রহমান ও মোঃ শাহ পরান।) 


ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন