বাড়ির আঙিনায় এখন আর ডালিম গাছ নেই

মাহমুদ রেজা চৌধুরী

এ বিষয়ে আলোচনা কেবল অনুমান বা ভাবনাকেন্দ্রিক হলে অনেকটা অসম্পূর্ণ আলোচনা হবে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে এর ইতিহাস পাঠ—পাশাপাশি একটি ‘আনুষ্ঠানিক’ বা একাডেমিক আলোচনা—বিষয়টার গুরুত্বকে যতটা উপস্থাপন করতে পারে, কেবল পর্যবেক্ষণের ওপর সেই আলোচনা অনেকটাই অসমাপ্ত আলোচনা জেনেই লিখছি। একটি কারণ, অনেক সময় কোনো আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে এর তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ও ইতিহাস ব্যাখ্যা, পাঠকের ধৈর্যে ব্যাঘাত ঘটাতেও পারে। আলোচনাটা স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য না। অনেকটা আড্ডায় মতবিনিময় করা।

ব্যক্তিগত ‘পর্যবেক্ষণ’কে ভিত্তি করে লিখছি। আলোচনার অসমাপ্ত দিককে পাঠক সহানুভূতিশীল মন নিয়ে পড়বেন বলে আশা করি।

পরিবর্তন এক ধরনের ‘গতিময়তার’ নিদর্শন।

একাত্তর-উত্তর আমাদের গ্রাম ও শহরের পরিবর্তন বলতে এক অর্থে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনকেও বোঝায়। সমাজ পরিবর্তনকে বুঝতে সমাজকাঠামো, এর বিভিন্ন স্তরবিন্যাস, তত্ত্ব ও এর প্রত্যয়গত সমস্যার দিকটাকেও বোঝা দরকার।

উল্লেখ্য, সমাজকাঠামোর ধারণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানী অনেকের মতেই বিদ্যমান সমাজকাঠামোর একটি জৈবিক (অর্গানিক) ধারণা, আরেকটি অজৈবিক (নন-অর্গানিক) ধারণার অধ্যায়নকে নির্দেশ করেন।

ব্রাউনের মতে, মানব সমাজ একটি ‘অর্গানিজম’ ছাড়া অন্য কিছু না। মানে, এর গড়নের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবদেহের মতো ‘পরস্পর’ অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আবার জীবদেহের মতোই সমাজকাঠামোর বিভিন্ন অংশকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথক করা যায়।

সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রয়াত ডক্টর রঙ্গলাল সেন তার এক রচনায় লিখেন, ‘সামাজিক কাঠামো হচ্ছে সমাজের মানুষের এমন সব পারস্পরিক পদমর্যাদা সম্পর্কের জালবিশেষ, যেসবের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অংশের পরস্পর নির্ভরশীলতা বর্ণনা করা যায়।’

মার্ক্সীয় ভাবনায়, মানবসমাজের প্রতিটি কাঠামো এক-একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। সমাজকাঠামো একটি ক্রমবিকশিত সত্তা। এখানে বাস্তব জীবন বলতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধরা হয়। আর সমাজে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি তারাই যারা ওই উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বা একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের রূপ-রূপান্তরকে বুঝতে উল্লেখিত অর্গানিক ও নন-অর্গানিক বিষয়কে মাথায় রেখে কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ নিয়ে লিখব। বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনে স্বাধীনতা-উত্তর সময় আমাদের নগর ও গ্রাম কোথায় কতটা অগ্রসর হয়েছে, কোথায় পিছিয়েছে—এ আলোচনায় সেই দিকটিই বুঝতে চেষ্টা করব। 

১৯৪৭-৭১ সময় আমরা নানা ধরনের ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে ছিলাম। ওই সময়টাতে পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর করে যে একটা পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো বা ব্যবস্থাপনা আমরা গড়েছিলাম, এর প্রভাব ও ফলাফল স্বাধীনতা-উত্তরকালে অবসান হয়েছে বলে জোর দিয়ে বলা যাবে না। পুঁজিবাদ দিনে দিনে উলঙ্গ ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, লেখা ও বক্তব্যে এ কথা বারবার বলেছেন। প্রফেসর চৌধুরী আরো বলেন, নগর ও গ্রামে গৃহকলহ আগেও ছিল, যা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে কোথাও গৃহযুদ্ধের আকার নিচ্ছে, বলে প্রফেসর চৌধুরী মনে করেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে স্বাধীনতা-উত্তর এবং স্বাধীনতা-পূর্বের নগর ও গ্রামের কোনো ‘পরিবর্তন’ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনে বড় কোনো ভূমিকা এখনো রাখতে পারেনি।

স্বাধীনতা-উত্তর সময় আমাদের নগর ও গ্রামের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটগুলো উল্লিখিত মন্তব্যের মধ্যে অনেকটা পেয়ে যাই। এসবকে খাটো করে দেখার অবকাশ কম।

পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ সময়ের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের পর একাত্তরে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি করলেও প্রকারান্তরে আমরা শাসকের শ্রেণীচরিত্রকে বদলাতে পারিনি, তবে মুখ ও মুখোশ এবং পোশাক বদলেছি অনেকবার। যার ফলে একাত্তর-উত্তর আমাদের সমাজ পরিবর্তনে গ্রাম ও নগরের ব্যবধান বলি বা পরিবর্তন বলি—এসবের গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি বলাটা হয়তো এক্ষেত্রে বাড়িয়ে বলা হবে না।

গ্রামের পরিবর্তন: ক. ‘গ্রাম’ কাকে বলি: যারা ষাটের দশকে বড় হয়েছি, এই আমাদের কাছে গ্রাম বলতে যে বিষয়টা দেখতাম ও বুঝতাম, সে রকম ‘গ্রাম’ এখন আছে কি? 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম কাকে বলি—এ ধারণা বদলেছে। যেমন আগে গ্রাম বলতে বুঝতাম বৈদ্যুতিক আলো নেই, হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো, জোনাকি পোকার ডাক, সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই রাত গভীর। ঘরের একটু পাশ দিয়ে নদী বয়ে যায়। অথবা খাল বা বিল। তাজা সব খাবার। সকালে নানান পাখির ডাক, মুরগির ডাকে ঘুম ভেঙে যাওয়া। সেই গ্রাম নেই। এখন গ্রামে ‘ডিপ ফ্রিজের’ খাবারও মেলে। ‘পোলট্রি ফার্মের’ মোরগ-মুরগি এবং ডিম পাওয়া যায়। একাত্তর-উত্তর গ্রাম বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা। নগরের কাছাকাছি চলে এসেছে গ্রাম। তাই গ্রাম কাকে বলি বা বলব এখন। এটাও স্বাধীনতা-উত্তর সমাজ পরিবর্তনে এই দুই জনপদের বাস্তবতায় দেখা দরকার।

খ. গ্রামের সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও অবনতি: স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের গ্রামগুলো এখন অনেক উন্নত। এখন আমরা গ্রাম বলতে কবি জসীমউদ্দীনের সেই কবিতা ‘কবর’, কতজনবা জানি বা পড়ি।

‘এইখানে তোর দাদির কবর, ডালিম গাছের তলে’।

গ্রামে এখন সে রকম ডালিমগাছ নেই, ডালিমের চাষ বেড়েছে পুঁজিবাদের স্বার্থে এবং বাণিজ্যের তাগিদে।

গ্রামে পৌঁছতে আগে যে ‘সময়’ লাগত এখন সেটা লাগে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। এর সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে নগর বনাম গ্রামের কিছু সামাজিক সম্পর্কের সরলরেখাগুলোও।

এ পরিবর্তনটা সম্পর্কের বাঁধনকেও দুর্বল করেছে বেশি। 

গ্রাম থেকে আসা শহরে অনেক ক্ষেত্রের থিতু হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বোধ বা জ্ঞানেরও অনেক তারতম্য ঘটেছে। তবে এ তারতম্যে যে গুণগত দিক সেটা গ্রাম থেকে আসা জনগোষ্ঠীর অনেকের মধ্যে সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। কেন পারেনি তার অনেক ব্যাখ্যা আছে। সেটা এ আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়।

গ. সুইচ অন, সুইচ অফ, ইচ্ছা: গ্রাম থেকে যে জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ নগরে এসেছে, তাদের মধ্যে এই ভাবনাটা বেশি কাজ করে। বলতে রাতারাতি সব পরিবর্তন চায় নিজেদের সেই অর্থে পরিবর্তন না করেই। যেমন শিক্ষা অর্জনের পরিবর্তন, শিক্ষার প্রতি অনেকের অনাগ্রহের পরিবর্তন। চিন্তার পরিবর্তন ইত্যাদি। এদের চাহিদাটা অনেকটা ঘরের বিদ্যুৎ-বাতির তাত্ক্ষণিক ‘সুইচ অন সুইচ অফ’ করার মতো দ্রুত চাই, যা-ই চাই।

এসবে গ্রাম থেকে নগরে আসা জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য স্বাধীনতা-উত্তরকালেও সেভাবে দেখছি না। 

ঘ. অর্থনীতি: এ ক্ষেত্রে গ্রামে বাজার বৃদ্ধি এবং এর সুযোগ বেড়েছে আগের তুলনায়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। যে কারণে বাজারের প্রসার হয়েছে এর চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মৌলিক দিক কৃষিনির্ভরতা। এই কৃষির উন্নতিতে গ্রামের ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি। গ্রামে আগে যে অর্থনৈতিক দরিদ্রতা ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে এ দিকটাতে আমাদের ইতিবাচক অর্থে উন্নতি হয়েছে। এ কারণে গ্রামের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ নারীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল, নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। গ্রামে ক্ষুদ্র নানান ধরনের কুটির শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিয়ে গ্রামকে অনেকটাই অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরশীল করেছেন নারীরা। এ আত্মনির্ভরশীলতার পাশাপাশি কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর জন্ম হয়েছে, এটাকেও অস্বীকার করা যাবে না ।

ঙ. লোকসংখ্যার পরিবর্তন। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকেই গ্রামের লোকসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমছে। কারণ গ্রাম থেকে অনেক লোক গ্রামের অর্থনীতির কিছুটা ভালো পরিবর্তন হলেও গ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছেন বেশি। কারণ আগের তুলনায় নগরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি অনেক বড়, সুযোগ-সুবিধাও অনেক। পাশাপাশি এটাও না বললেই নয় যে বিগত পাঁচ দশক আমাদের রাজনীতির নানান পরিবর্তনের কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে ছুটে আসছে, এই দিকটাতেও নিজের একটা সুযোগ-সুবিধার স্বপ্ন নিয়ে। এ সময়ে হালুয়া-রুটির রাজনীতির প্রাধান্য অনেকটা। হালুয়া-রুটি কে না পেতে চায়?

চ. বস্তুগত চাহিদার সংস্কৃতি: গ্রামের মানুষ এখন শহরের মানুষের মতোই এ ব্যাপারেও সচেতন আগের তুলনায় অনেক বেশি। অনেকের মতে, গ্রামের জনজীবনেও ‘পুঁজিবাদী’ চিন্তা ও সংস্কৃতির টান বাড়ছে। একটি কারণ এভাবে বলা যেতে পারে, আমাদের স্বাধীনতার আগে গ্রাম থেকে শহরে আসার সুযোগ-সুবিধা কম ছিল। তেমনি গ্রামের কোনো যুবক দেশান্তরিত হবেন, এ সুযোগও তেমন ছিল না। 

স্বাধীনতার পর পর লক্ষ করেছি, গ্রামের একজন কৃষকের ছেলে কিংবা শ্রমিকের সন্তান দ্রুত দেশান্তরিত হচ্ছেন ও হয়েছেন। তাদের এ দেশান্তর কিংবা প্রবাসী হওয়ার কারণে গ্রামের কৃষক ও শ্রমিকের সন্তানদের ভেতরেও নগরের ধনী পিতামাতার সন্তানদের মতো এক ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের জীবন ও জীবনের দৃষ্টিপাতকে বদলেছে।

গ্রামের যুবকদের সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই গ্রামের কৃষক ও শ্রমিকের সন্তানদের খুব বেশি সংখ্যায় আমরা এই অভিবাসীর তালিকায় পাই। এ এদের অর্থায়নে গ্রামে ব্যক্তি ও পরিবার গোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছে বলেও বলা যায়। এটা আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামের সামাজিক পরিবর্তনের একটি রেখা। আমাদের শিক্ষিত নগরবাসী যুবকদের যে অংশ প্রবাসী হয়েছে, বিশেষ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে, নগরের সামাজিক পরিবর্তনে তাদের ইতিবাচক তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এদের কোনো রেমিটেন্স সেই অর্থে দেশের বৈদেশিক তহবিলের তেমন কোনো বড় অংক না। 


মাহমুদ রেজা চৌধুরী: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন