একটা সময় ছিল যখন গ্রামের মানুষের কাছে মোবাইল ফোন ব্যবহার ছিল অনেকটা বিলাসিতার মতো। মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে গ্রামের সেই একই মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠল মোবাইল ফোন। আর এখন শুধু যোগাযোগ মাধ্যম নয়, মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই মোবাইল ফোন।
ময়মনসিংহ অথবা কুড়িগ্রামের গ্রাম থেকেই একজন কৃষক এখন সরাসরি ঢাকায় থাকা ভোক্তার কাছে উৎপাদিত পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। মাধ্যম ক্রেতা ও বিক্রেতার হাতে থাকা স্মার্টফোন ও মোবাইল ইন্টারনেট। গ্রামে মাছ, মুরগির খামারে মড়ক লাগা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। মোবাইল ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন গ্রামে বসেই খামারিরা পেয়ে যাচ্ছেন মড়ক প্রতিরোধের সমাধান। স্মার্টফোনে আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত দেখে উপকূল অঞ্চলের মাঝিরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সাগরে মাছ ধরতে যাবেন কি যাবেন না। জীবিকার তাগিদে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে রিকশা চালাতে আসা ব্যক্তি মোবাইলে এখন এক মুহূর্তেই টাকা পাঠাতে পারছেন গ্রামে থাকা তার পরিবারের কাছে। শুধু স্মার্টফোন বা মোবাইল ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে গ্রামে বসেই অনেকে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, পণ্যের উৎপাদন বাড়াচ্ছেন—এমন সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা কিন্তু একেবারেই কম নয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি ফর ডেভেলপমেন্ট’-এর একটি গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেনি এমন এলাকায় অকৃষি খাতের নানা ব্যবসায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে একটি পরিবারের আয় বাড়ছে ৭ থেকে ১১ শতাংশ। অন্যদিকে মাছ চাষে একজন খামারি সেলফোনের মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারছেন ৭-১০ শতাংশ পর্যন্ত।
গবেষণার এ হিসাব বিদ্যুৎ সুবিধা নেই এমন গ্রামের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে করা। আর যেসব গ্রামে এখন বিদ্যুৎ সুবিধা আছে সেখানকার মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মোবাইল ফোনের ভূমিকা যে আরো অনেক বেশি তা বুঝতে পারা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। এর পরও এ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক গবেষণা হলে মোবাইল ফোনের বদৌলতে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রকৃত চিত্র আমরা পাব।
করোনা মহামারীর এ সময়ে মানুষের মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার ও নির্ভরতা আরো বেড়েছে। তবে এ ব্যবহার বেড়েছে মূলত অন্য কোনো বিকল্প না থাকায়। মোবাইল ফোনে দ্রুত যোগাযোগ সুবিধার কারণে গ্রামে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে অন্যদিকে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনও লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেমন এটুআই ও রবির সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে পরিচালিত ৩৩৩ কল সেন্টারের কল্যাণে গ্রাম পর্যায়ে ২০১৯-এর মে পর্যন্ত এক বছরে তিন হাজারের বেশি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। ৯৯৯ সেবায় কল করে অনেকে বড় ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন এবং অন্যায়-অপকর্ম সম্পর্কে প্রশাসনকে অবহিত করা সম্ভব হয়েছে। মূলত মোবাইল সেবার ফলে সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন।
আমরা জাতীয় অর্থনীতির উন্নতির সূচক হিসেবে শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই জিডিপির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করি। কিন্তু মোবাইলের সামাজিক প্রভাবটাও বিশাল, যা অর্থে পরিমাপ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। এজন্যই মোবাইল প্রযুক্তিকে বলা হয় ‘এনেবলিং ফ্যাক্টর’ অথবা সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাবক। বিদেশ থেকে কোনো প্রবাসী যখন গ্রামে থাকা তার পরিবারের কাছে ফোন করে পরিবারের আয়-উন্নতির পরিকল্পনা করেন তখন তার সামাজিক গুরুত্ব শুধু অর্থে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। টেলিযোগাযোগ সেবাকে অনেক সময় বলা হয় ব্যয়বহুল। তবে এ সেবা যদি মানুষের হাতের নাগালে না থেকে তাহলে তার ক্ষতি অনেক গুণ বেশি।
জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট দ্রুত তৈরিতেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে মোবাইল প্রযুক্তি। মোবাইল নম্বরের সাথে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের কাজ দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে। এতে গ্রাম থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মানুষের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। এভাবেই মোবাইলভিত্তিক সেবার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্যকে আমরা কমিয়ে আনতে পারি। প্রতিটি গ্রামকে আমরা ‘স্মার্ট ভিলেজ’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, যেখানে ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ ও ‘অ্যাকসেস টু সার্ভিস’ অর্থাৎ তথ্যসেবা প্রাপ্তিতে শহরের সাথে গ্রামের কোনো তফাত থাকবে না।
গ্রামে এ ডিজিটাল বিপ্লবকে আরো ছড়িয়ে দিতে তিনটি বিষয়ের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। প্রথমত, বাংলায় সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী বিষয়বস্তু অথবা কনটেন্ট তৈরিতে জোর দেয়া। মোবাইল সংযোগ প্রাপ্তি সহজলভ্য করা। এজন্য কর কাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। এরপর সাধারণ মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এখানে মোবাইল ফোন বলতে আমরা স্মার্টফোনকে বোঝাতে চাচ্ছি। স্মার্টফোন ছাড়া ডিজিটাল এ বিপ্লবকে পূর্ণতা দেয়া সম্ভব নয়।
একটি বিষয় আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, মোবাইলভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ চিত্র সামগ্রিকভাবে এখনো পরিপূর্ণতা পায়নি। এর মূল কারণ হলো সবার কাছে এখনো স্মার্টফোনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে না পারা। দেশের এখন প্রায় শতভাগ এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আছে, যেটাকে আমরা বলি টুজি সেবা। আর মোবাইল ইন্টারনেটভিত্তিক ফোরজি সেবা এখন দেশের ৮০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যমান। কিন্তু সে দুলনায় আমাদের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সংখ্যা এখনো ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এ পরিসংখ্যান হতাশার হলেও আশার খবর হচ্ছে, ৪০ শতাংশের কম স্মার্টফোন ব্যবহারকারী নিয়েই কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান চিত্রটি আমরা আঁকতে পেরেছি। শুধু স্মার্টফোন ব্যবহারকারী যদি আমরা দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি ভিন্ন পর্যায়ে নেয়া সম্ভব।
আমার মনে হয়, এ বিষয়ে গভীরভাবে দৃষ্টি প্রদানের সময় এখন চলে এসেছে। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো এগিয়ে নিতে হলে সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন পৌঁছে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প এখন নেই। একসময় ঘরে ঘরে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সেটি এখন স্মার্টফোন দিয়েই করা সম্ভব।
স্মার্টফোন ব্যবহার যে আমাদের দেশে এখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না তার মূল কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এর সাথে ইন্টারনেটের মূল্যও আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশে একটি মানসম্পন্ন ফোরজি স্মার্টফোন এখনো ৬ হাজার টাকার কমে পাওয়া যায় না। সবার এখনো এত টাকা ব্যয় করে স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। এক্ষেত্রে সরকার থেকে সাধারণ মানুষেক যদি একটি ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে খুবই ভালো হয়। এনজিওগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। তারা গ্রামের মানুষকে স্মার্টফোন কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে। এভাবে যদি আমরা স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে পারি তাহলে ডিজিটাল বিপ্লবের পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে আমাদের খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।
স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ইন্টারনেটের মূল্য। বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য বিশ্বে অন্যতম সর্বনিম্ন হলেও তা এখনো অনেকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নয়। মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো বেতার তরঙ্গ এবং অন্যটি অপটিক্যাল ফাইবার। এ দুটির মূল্যই বাংলাদেশে অনেক বেশি। ইন্টারনেটের মূল্য আরো কমিয়ে আনতে হলে তরঙ্গ ও ফাইবার নিয়ে কিছু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। সেটি করা হলেই আরো কম দামে মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে স্মার্টফোন উৎপাদন ও আমদানি করনীতিতেও বেশকিছু বাস্তবমুখী সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজন শিল্পকে উৎসাহিত করতে গিয়ে আমদানি পর্যায়ে কর যে পর্যায়ে নেয়া হয়েছে তাতে স্মার্টফোনের দাম কম রাখা সম্ভব নয়। আবার মোবাইল ফোন সংযোজন শিল্পের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্কনীতিতেও রয়েছে অসামঞ্জ্য। আমরা মনে করি, স্মার্টফোন বা মোবাইল ফোনকে শুধু একটি পণ্য হিসেবে বিবেচনা না করে সামগ্রিক অর্থনীতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বকে বিবেচনায় নিয়ে এর করনীতি ঠিক করা প্রয়োজন।
মোবাইল ফোন ছাড়া সরকারি দপ্তরের নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক ক্ষতি কতটুকু সেটি বিবেচনায় নিলে একটি সময়োপযোগী করনীতিমালা অবশ্যই তৈরি করা সম্ভব। যোগাযোগ, ডিজিটাল সেবাপ্রাপ্তি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আরো এগিয়ে নিতে হলে এখন প্রয়োজন প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ এখন সময়ের দাবি। আমরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করি তাহলে গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য পূরণ খুব একটা কঠিন হবে না। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
সাহেদ আলম: টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ