মাদ্রাসা শিক্ষার সম্প্রসারণ ও বহুমুখিতা

আহসান হাবীব

বাংলাদেশে বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা অন্যতম একটি প্রভাবশালী মাধ্যম। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালে সম্পাদিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ২৩ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। ব্যানবেইস তাদের পরিসংখ্যানে আলিয়া ও কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলোকেই লিপিবদ্ধ করেছে। এর মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ৩১৯ ও কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৩ হাজার ৯০২। এ মাদ্রাসাগুলোয় প্রায় ৫৩ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এর বাইরেও উপ-আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রদানের জন্য অনেক মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসাগুলোর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সংখ্যার পাশাপাশি শিক্ষাদান পদ্ধতি ও কারিকুলামেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখনো সামগ্রিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসায় শিক্ষিত মানুষ নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া চালু রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে অনেকে পশ্চাত্পদ, অনগ্রসর, সেকেলে ও ধর্মান্ধ তৈরির কারখানা বলেন। সমাজের একটা শ্রেণী থেকে সবসময়ই মাদ্রাসাকে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও গোঁড়ামির কেন্দ্র হিসেবে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এর পরও মাদ্রাসা শিক্ষার আশানুরূপ আধুনিকায়ন ও পরিবর্তন হয়নি। বরং মাদ্রাসার সংখ্যা ও শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারণের কারণ ও এর বহুবিধতা নিয়ে এ লেখায় আলোকপাত করব।

মাদ্রাসা বলতে আমরা সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বুঝি। বাংলাদেশে মাদ্রাসাগুলোয় ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক, বিজ্ঞান ও অন্যান্য সামাজিক বিষয়গুলোকেও পড়ানো হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা কোনো একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা না। মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে রয়েছে অনেক ধারা ও উপধারা। এর মধ্যে আলিয়া ও কওমি হলো প্রধান দুটি ধারা। অন্যান্য ধারার মধ্যে নুরানি, ফোরকানিয়া, কারিয়ানা, হাফেজি অন্যতম। আলিয়া ধারার মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে মৌলিক কাঠামোগত অনেক ধরনের সামঞ্জস্য বিদ্যমান। কেননা আলিয়া মাদ্রাসার ওপরে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অন্যদিকে কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলো আবার বহুধাবিভক্ত। ইসলাম ধর্মের অনেক বিষয় নিয়ে কওমি ধারাগুলোর মধ্যে আদর্শিক অমিল দৃশ্যমান। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো একই কারিকুলামে পরিচালিত হলেও কওমি মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলামে একটার সঙ্গে অন্যটার দৃশ্যমান ভিন্নতা রয়েছে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার ধারাগুলোর মধ্যে প্রভাববলয় তৈরির এক ধরনের প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। প্রত্যেকেই তার চিন্তা ও আদর্শের লোক তৈরির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে চান। এজন্য যখন কেউ কোনো এক ধারা থেকে লেখাপড়া শেষ করে ভালো আলেম হন, তিনি নিজ এলাকায় গিয়ে নিজ মতাদর্শ ও চিন্তার আলেম তৈরির জন্য মাদ্রাসা তৈরি করেন। তাই আমরা অনেক সময় একই গ্রামে বা এলাকায় একাধিক কওমি মাদ্রাসার উপস্থিতি দেখি। আবার কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করে বাংলাদেশের মূলধারার পেশাগুলোয় চাকরির সুযোগ তুলনামূলক কম থাকার কারণেও তারা নিজেদের কর্মসংস্থানের একটা স্থায়ী মাধ্যম হিসেবে নতুন করে আবার মাদ্রাসা-ই প্রতিষ্ঠা করেন।

মাত্র দুই দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একজন শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি হতো মক্তবে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। বর্তমানেও অনেক এলাকায় মক্তব চালু রয়েছে। তবে মক্তবের সংখ্যা, পাঠদান পদ্ধতি ও কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইসলাম ধর্ম, আরবি ভাষা ও সামাজিক আচার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাগুলো মক্তবে শেখানো হয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক গ্রামে কয়েক বছর আগেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সেসব স্থানে শিশুর লেখাপড়ার প্রাথমিক বিষয়গুলো ছিল মক্তব নির্ভর। সারা দেশে এনজিওগুলোর বিশেষ করে ব্র্যাকের প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়। সমগ্র বাংলাদেশে বর্তমানে ব্র্যাকের প্রায় ২৩ হাজার স্কুল রয়েছে। এসব স্কুলের সঙ্গে অন্যান্য এনজিও, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সম্প্রসারণ গ্রামাঞ্চলে মক্তবের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। কিন্তু অভিভাবকদের অনেকেই সন্তানদের ইসলামী শিক্ষার বিষয়ে বিকল্প প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করেন। এ প্রয়োজনগুলো থেকে অনেক স্থানে মক্তবের অনুপস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসা স্থাপিত হতে থাকে।

গ্রামাঞ্চলে মক্তব কিংবা মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার একটা রীতি ছিল, সেখানে যারা পড়ালেখা করত, তাদের নিয়মিত বেতন দিতে হতো না। মাদ্রাসার শিক্ষক বা ‘হুজুর’রা এলাকার মানুষদের বিভিন্ন বাড়িতে ধারাবাহিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ ও বেতনের জন্য এলাকার মানুষ মৌসুম শেষে ফসল উত্তোলনের পরে একটা নির্দিষ্ট অংশ শস্য বা ফসল মাদ্রাসাগুলোয় দান করে দিতেন। অর্থাৎ মাদ্রাসা ছিল এলাকার মানুষের শ্রমে ও ঘামে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ধারায় বর্তমানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন নগদ টাকা বেতন দিয়েই অধিকাংশ মাদ্রাসায় বিশেষ করে আলিয়া ধারার মাদ্রাসাগুলোয় পড়তে হয়। অন্যদিকে কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলো এখনো মানুষের দান-অনুদানের ওপর নির্ভর করেই পরিচালিত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোয় পড়ালেখার খরচ তুলনামূলকভাবে স্কুলের চেয়ে কম। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের মধ্যে এটা একটা কমন ধারণা যে পরিবারের একটি সন্তান অন্তত মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা উচিত। তারা মনে করে মাদ্রাসায় শিক্ষিত কোনো সন্তান মৃত্যুর পরের জীবনে তথা পরকালে মা-বাবা বা অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের জান্নাত পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। তাছাড়া নিয়মিত মিলাদ, দোয়া, জানাজার নামাজ প্রভৃতির জন্যও পরিবার বা বংশের মধ্য থেকে কোনো একজনের মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিত। অর্থনৈতিকভাবেও যেহেতু মাদ্রাসা শিক্ষার খরচ তুলনামূলক কম, সেহেতু অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল অনেক অভিভাবক সন্তানদের মাদ্রাসায় দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন।

গ্রামাঞ্চলে এমনকি শহরেও এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যারা সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে পারেন না। তারা সন্তানদের মাদ্রাসায় দিয়ে দেন। কেননা মাদ্রাসাগুলোয় থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বরং নিশ্চিন্তে সেখানে সন্তান বড় হতে পারে। বয়স বাড়ার পরে তাকে কাজে লাগিয়ে দেয়া যায়। দরিদ্র পরিবারের অনেকে সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ানোকে তাদের আয়ের মাধ্যম হিসেবেও মনে করে। দরিদ্র পরিবারের কোনো সন্তান যদি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে, সেক্ষেত্রে এলাকার ধনী মানুষ, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা সওয়াবের আশায় তাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় পরিবারের কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া বা মিলাদ, বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি কামনা, রোগ থেকে আরোগ্য লাভের আশায় এসব মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। খাওয়ানোর পরে আবার তাদের প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাও প্রদান করা হয়। এসব কারণ বিবেচনায় অনেক অভিভাবক সন্তানদের মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান।

বাংলাদেশে স্বাধীনতাপরবর্তী প্রায় প্রত্যেকটি সরকারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারণে কাজ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ইসলাম ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল থাকার কারণে প্রায় সব সরকারই মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার, আধুনিকায়ন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয়, কারিকুলাম ও সিলেবাস পরিবর্তন, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এর খুব অল্পই সফলতার মুখ দেখেছে। কেননা কোনো সরকারই মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অসন্তুষ্টির কারণ হতে চায়নি। প্রকাশ্যে অনেকে মাদ্রাসাগুলোর সংস্কার ও মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করলেও পর্দার অন্তরালে সবাই তাদের সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছে। এর বিপরীতে মাদ্রাসাগুলো নিয়ে এক ধরনের ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রচার রয়েছে। এ নেতিবাচক প্রচারগুলোর কারণে মাদ্রাসাগুলো ও মাদ্রাসা শিক্ষিত অনেকেই সমাজের মূল ধারায় সমান সুযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। যা তাদের মূলত: নিজ গণ্ডির মধ্যে থাকতেই উদ্ধুদ্ধ করে। ঠিক যেমনটি ইংলিশ মাধ্যমের স্কুলগুলো। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি চর্চায় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের প্রচলিত সামাজিক আচার অনুশীলনের চেয়ে ভিন্ন। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের ‘বর্ণ প্রথা’ বিদ্যমান। যেখানে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ মাদ্রাসাকে দেখেনে নিম্নবর্ণের শিক্ষামাধ্যম হিসেবে। এরা মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনে করেন অচ্ছুত ও নিকৃষ্ট জীব হিসেবে। যেমনটা এক সময় উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণরা নিচু বর্ণের তথা শুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে করত। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে বাধ্য করছে।

গত এক-দুই দশকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে বড় বড় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলারা যুক্ত হয়েছেন। গত ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সরকার প্রত্যেক সংসদ সদস্যের নিজ এলাকায় খরচের জন্য ২ কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ করেছিল। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রথম আমলে বরাদ্দের এই অংক বাড়িয়ে প্রত্যেক সংসদ সদস্যদের জন্য বছরে ৩ কোটি টাকা করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে টাকার পরিমাণ বেড়ে বছরে ৪ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ একজন সংসদ সদস্য তার পূর্ণ মেয়াদে ২০ কোটি টাকা পাবেন স্থানীয় উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য। এ টাকা খরচের দৃশ্যমান খাতগুলো তুলনামূলক কম থাকায় অনেক সংসদ সদস্য মাদ্রাসায় অনুদান ও নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজে একটি অংশ ব্যয় করেন। এমনকি যেসব সংসদ সদস্য মাদ্রাসা শিক্ষার সমালোচনা করে জাতীয় সংসদ বা জনসভায় বক্তৃতা করেন, তারাও নিজ এলাকায় মাদ্রাসার সম্প সারণে টাকা বরাদ্দ করেন। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করে। প্রথমত এর মাধ্যমে স্থানীয় আলেম সমাজের সমর্থন পাওয়া যায়, যা ভোটের রাজনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত প্রায় সব মাদ্রাসা ও বড় মসজিদে প্রতি বছর ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। প্রত্যেকটি ওয়াজে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকে। ওয়াজ শুনতে প্রচুর লোক সমাগম হয়। মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোর ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের পেছনে মানুষকে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি আরেকটা বড় উদ্দেশ্য থাকে অনুদান সংগ্রহ। ওয়াজের সময় সংগৃহীত অনুদান দিয়ে এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তার পরবর্তী বছরের নিয়মিত ব্যয় ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে। প্রধান অতিথি হিসেবে সংসদ সদস্যরা বিশাল জনসমাগমের সামনে একটা বড় অংকের অনুদানের ঘোষণা দিয়ে আত্মতৃপ্ত হন। এ কথা বলা যায় যে মাদ্রাসাগুলোর গুণগত পরিবর্তন ও মান উন্নয়নে ভূমিকা না থাকলেও অনুদান প্রদান, মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদরা ভূমিকা রাখছেন।

বাংলাদেশ বর্তমানে কোটিপতি বা ধনী শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি বিবেচনায় দ্রুত বর্ধমান দেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে আয় বৈষম্য প্রকট। ব্যবসায়ী, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের মতো পেশাগুলোর মধ্য থেকেই ধনিক শ্রেণীর মানুষ বেশি দেখা যাচ্ছে। অর্থ উপার্জনে এসব ধনী মানুষদের বৈধ উপায়ের পাশাপাশি অনেকের অনেক অবৈধ ও অসাধু উপায়ও রয়েছে। এদের অনেকের মধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাপবোধ তৈরি হতে থাকে। তখন অনেকে আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে হজ পালন করেন। পাশাপাশি অনেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এছাড়া অনেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেও মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু স্কুলগুলোর অধিকাংশ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয় এবং বাকিগুলো ব্যবসায়িক উদ্যোগে পরিচালিত হয়, সেহেতু সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে অনেকে স্কুল প্রতিষ্ঠার চেয়ে মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দেন। এর মাধ্যমে ধর্মীয়ভাবে পূণ্যবান হওয়ার বিষয়টিও তাদের বিবেচনাধীন থাকে।

মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নেতিবাচক বিষয় নয়। তবে এর সুফল ভালোভাবে পাওয়ার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার বহুধাবিভক্ত ধারাগুলো কমিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা অনেকেই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেধা তালিকার শীর্ষেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দেখা যায়। এদের অনেকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সব পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে চাকরি করছে এমন সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। এটা সম্ভব হয়েছে আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলামের আধুনিকায়ন, আরবি ও ইসলামী বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়গুলোর সংমিশ্রণ, সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির কারণে। যদিও মাদ্রাসা থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েও সরকারি চাকরি প্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। তার পরও বাংলাদেশে আলিয়া মাদ্রাসাগুলো সমাজের মূল ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই অনেকের কাছে বিবেচিত হয়। একইভাবে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলামে একটা সমরূপিতা বা সাদৃশ্য তৈরি, বাংলা ও ইংরেজির প্রতি গুরুত্বারোপ, সমাজের মূল ধারার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, মাদ্রাসায় পড়ুয়ারাও আমাদের সমাজের অংশ। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক সম্প্রীতি ও নিরাপত্তায় তাদের ভূমিকা অনেক। মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ন রেখে তাদের মতামত ও সন্তুষ্টিকে সম্মান করে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে আসতে পারলে তারা সমৃদ্ধ জাতি গঠনের অবিচ্ছেদ্য কারিগর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে।


আহসান হাবীব: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন