নাগরিক প্রতিবেদন

তরুণ প্রজন্মকে সংবিধানের ইতিহাস জানানো জরুরি : ড. কামাল হোসেন

মাসরেফা তারান্নুম

তরুণ প্রজন্মের নীতি গবেষণামূলক প্ল্যাটফর্ম ‘ইয়ুথ পলিসি ফোরামের’ (ওয়াইপিএফ) আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে টকিং পলিসিস সিরিজের ৬ষ্ঠ পর্ব। ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ ওয়েবিনারে  যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস এবং এর নানাদিক নিয়ে আলোচনা করা হয়।

ওয়াইপিএফ এর উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আখতার মাহমুদের সঞ্চালনায় এবারের পর্বে আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা, সাবেক আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই সংবিধান রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনায় ১৯৪৭ এর পাকিস্তান সৃষ্টির আগের ইতিহাসে আলোকপাত করেন ড. আখতার মাহমুদ। তিনি বলেন, মূলত যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান, তার সূত্রপাত সংবিধান রচনার বহু আগে থেকেই এ অঞ্চলের জনমানবের মনে তৈরি হয়। 

এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনও একমত পোষণ করে বলেন, ১৯৫৪ এর ২১ দফা ও পরবর্তীকালে ১৯৬৯ ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন সংবিধানকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল।

সংবিধান তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে ফেরার পরপরেই সংবিধান তৈরি নিয়ে কাজ শুরু হয়ে যায়।

পরবর্তীতে কমিটি গঠন করা হয় ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে সংবিধানটি রচনা করা হবে বাংলা ভাষায়। তবে বাংলা ভাষার পাশাপাশি সংবিধানের সঠিক অভিব্যক্তি বজায় রেখে ইংরেজিতেও রচনার কাজটি করা হয়েছিল। প্রফেসর আনিসুজ্জামান বাংলায় ও ড. কামাল হোসেন ইংরেজিতে রচনার কাজ করছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল সংবিধান রচনার জন্য প্রথম আলোচনার আয়োজন করা হয়, যা ড. কামাল হোসেনের কাছে ব্যক্তিগতভাবে খুবই আবেগঘন একটি দিন ছিল। সে সময় বয়সে তরুণ হওয়ার কারণে তিনি প্রথমে কিছুটা দ্বিধাবোধ করলেও বঙ্গবন্ধুর আশ্বাসে ও পরবর্তীতে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের আন্তরিকতার কারণে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেন।

সংবিধান প্রণয়নের সময় মূলত আইনি দিক বিবেচনা করা হয়েছে অথচ পরবর্তীতে রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এর সমান গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে- এমন কোনো ঘটনা তৎকালীন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে কিনা সে সম্পর্কে জানতে চান সঞ্চালক ড. আখতার মাহমুদ। এর উত্তরে একটি ঘটনা উল্লেখ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধানের ৭৮ নং অনুচ্ছেদটির ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাপার দেখা যায়। এ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো দলের ব্যক্তি তার দলকে সমর্থন না করলে সংসদে তার আসন হারাবেন। ড. কামাল হোসেন সহ সমসাময়িক তরুণ সংবিধান প্রণেতারা এর বিরোধিতা করলেও তাজউদ্দীন আহমদ ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা দলীয় সংহতির জন্য এই আইনটির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। এছাড়াও কিছু ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির  সদস্যদের মধ্যে মতভেদ হলেও পরবর্তীতে সেসব বিষয়ে যথাযথ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যমতে আসা হয় বলে জানান তিনি।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায়  আমাদের জন্য রাষ্ট্রপতিপ্রধান সরকার ব্যবস্থা নাকি মন্ত্রিসভাপ্রধান সরকার ব্যবস্থা -কোনটি বেশি উপযুক্ত জানতে চাওয়া হলে ড. কামাল হোসেন মন্ত্রিসভাপ্রধান সরকারব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, এটি ৬ দফা দাবির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনের বিপুল জনসমর্থনের ৬ দফার অবদান যেহেতু অনস্বীকার্য, তাই স্বাধীন দেশে ৬ দফার বাস্তবায়নে মন্ত্রিসভাপ্রধান সরকারব্যবস্থা তৈরি জরুরি ছিল।

সংবিধান রচনার ঐক্য ও সংহতি চিরকালীন উল্লেখ করে অদূর ভবিষ্যতে সংবিধানকে রক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে এমনটা মনে হয়েছিল কিনা জানতে চাওয়া হলে ড. কামাল হোসেন বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আশা নিয়ে সংবিধান তৈরি হয়েছিল, সেই আশাবাদ থেকেই ভবিষ্যতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।এছাড়াও একটি জাতির আগ্রহের বিষয় সে জাতির রাজনীতিতে প্রাধান্য প্রাপ্ত ক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

পরিশেষে তিনি সংবিধান রচনার প্রেক্ষাপট ও সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনসহ যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়েছিল নতুন প্রজন্মকে সে বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়াকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন।

• শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন