ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা

পিছিয়ে পড়েছে শ্রীকাইল ইস্ট থেকে গ্যাস উত্তোলন

আবু তাহের

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) অনুসন্ধানে কুমিল্লার শ্রীকাইল পূর্ব জোনে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় চলতি বছরের মার্চে। চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হবে বলে সে সময় জানিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। যদিও আট মাসে ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়া আর কোনো কাজ এগোয়নি গ্যাসক্ষেত্রটিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাছাকাছি প্রসেস প্ল্যান্ট থাকার কারণে গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরুতে এতটা সময় লাগার কথা না। অন্যদিকে মূলত ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণেই এখান থেকে এখনো গ্যাস উত্তোলন শুরু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

বাপেক্সের কর্মকর্তারা বলছেন, জমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পাইপলাইন বসিয়ে কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হতে পারে আগামী মার্চ নাগাদ। উত্তোলন শুরু হলে এখান থেকে দৈনিক ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর কাছাকাছি প্রসেস প্ল্যান্ট থাকলে শুধু পাইপলাইন টেনেই উত্তোলনকৃত গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্টে নিয়ে আসা হয়। এরপর তা সেখান থেকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সব মিলিয়ে মাসখানেকের মধ্যেই উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করা যায়। তবে সেজন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি জড়িত থাকলে সেক্ষেত্রে -সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিষ্পত্তির ওপরেই নির্ভর করে সবকিছু।

জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানিয়েছিলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই শ্রীকাইল ইস্ট গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস যুক্ত হবে। জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, শ্রীকাইল ইস্টে মোট ৭১ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস পাওয়া গেছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই শ্রীকাইল ইস্ট- থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এখান থেকে যদি প্রতিদিন ১০-১২ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস উত্তোলন করা হয়, তার পরও ১০-১৫ বছর পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

২০১৭ ২০১৮ সালে শ্রীকাইলের হাজীপুর বাঙ্গুরা এলাকার ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে গ্যাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে বাপেক্স। এরপর ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবরে অনুসন্ধান কূপ শ্রীকাইল ইস্ট- শিরোনামে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারিতে শেষ হয়। এরপর প্রায় তিন কিলোমিটার গভীর কূপ খনন করা হয়। সে সময় ওই কূপ খননে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চলতি বছরের মার্চ শ্রীকাইলে গ্যাস পায় বাপেক্স। কূপে গ্যাস মজুতের পরিমাণ ৭১ বিসিএফ। উত্তোলন করা যাবে ৫০ বিসিএফ। কূপে প্রায় হাজার ৮০ মিটার গভীরে গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে। কূপটি থেকে প্রতিদিন ১০-১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

জানা গেছে, শ্রীকাইলে পূর্ব জোনে গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর জন্য ওই এলাকার হাজার ২০০ শতাংশ জমি লিজ নিয়েছিল বাপেক্স। এর মধ্যে কৃষিজমির ক্ষেত্রে জমিদাতাদের শতাংশপ্রতি হাজার ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হবে বলে ধার্য করা হয়। গ্যাস পাওয়ার পর জমি স্থায়ীভাবে অধিগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য অর্থছাড় করা হয়েছে।

কূপ থেকে প্রসেস প্ল্যান্ট পর্যন্ত গ্যাস গ্যাদারিং পাইপলাইন অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য গত জুলাই টেন্ডারের জন্য আলোচনা সভা করে বাপেক্স। আলোচনা সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরপ্রস্তাবকারী ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়। ঠিকাদার পরবর্তী পাঁচ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করবে বলে ওই সময়ে জানিয়েছিল বাপেক্স।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, শ্রীকাইল ইস্টে যে জায়গায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত ভূমি মালিকদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় ভূমি মালিকদের সঙ্গে নানা ধরনের জটিলতা ছিল। এরই মধ্যে সে জটিলতাগুলো অনেকটাই নিষ্পত্তি করে আনা হয়েছে। এখন জমির মালিকদের জমি বাবদ পাওনা অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার পর সেখানে প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করা যাবে। এছাড়া যে জায়গায় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটি আবাদি জমি। বর্ষা মৌসুমে সেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে প্রকল্প এলাকায় তেমন কোনো কাজ হয়নি।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, শ্রীকাইল ইস্টে যেখানে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে, সেখান থেকে প্রসেস প্ল্যান্ট মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার। দূরত্বে পাইললাইন টানার জন্য যে জমির ওপর দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে, সেটি আগে অধিগ্রহণ করতে হবে। শ্রীকাইলে জমি অধিগ্রহণেই অনেক বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।

গ্যাস পেতে দেরি হওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে বাপেক্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রীকাইল ইস্টে যে ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়েছে, তিনি গ্যাস গ্যাদারিংয়ের জন্য দেশের বাইরে থেকে পাইপ নিয়ে আসবেন। এরই মধ্যে পাইপের জন্য এলসি খোলা হয়েছে। রেডি শেলফে পাইপ পাওয়া যায় না। অর্ডার দিয়ে আনতে হয়। ফলে সময় লাগে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি শুষ্ক মৌসুমে পাইপ দেশে আসবে। সেটি আসার পর বসানো হবে।

তবে ঠিক কত সময়ের ভেতরে গ্যাস জাতীয় গ্রিড লাইনে আসবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রিডে গ্যাস যোগ হবে।

শ্রীকাইল ইস্ট থেকে গ্যাস উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শাহজাহান বণিক বার্তাকে জানান, গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। তাছাড়া আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র এলাকা আবাদি জমি হওয়ায় সেখানে পানি ছিল দীর্ঘ সময়। ফলে কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়।

তিনি বলেন, গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য টেন্ডার করা হয়েছে, যেটি করোনার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়। এখন টেন্ডার করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চের শেষ নাগাদ আমরা এখান থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন