রিজার্ভের অর্থ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

হাছান আদনান

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো যেকোন দেশের নিরাপত্তাবলয়। কোনো দেশের রিজার্ভ যত শক্তিশালী, ওই দেশের প্রতি বিদেশী বিনিয়োগকারী দাতা সংস্থার আস্থাও তত বেশি। করোনাভাইরাস বিশ্বের অনেক দেশের রিজার্ভকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেললেও সময়ে শক্তিশালী হয়েছে বাংলাদেশের রিজার্ভ। গত পাঁচ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে প্রায় বিলিয়ন ডলার। অক্টোবর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

রিজার্ভে থাকা অর্থ বিশ্বের শক্তিশালী ১১টি মুদ্রায় সংরক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি রাখা হয় ইউএস ডলারে। প্রয়োজন অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার থেকে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়লেই এর বিনিয়োগ নিয়ে কথা ওঠে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহল থেকে। সম্প্রতি রিজার্ভ থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের কথা আবারো জোরালো হয়ে উঠেছে। সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি আলোচনা হচ্ছে বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়টিও। সম্প্রতি একাধিক বেসরকারি শিল্প গ্রুপ বিনিয়োগের জন্য রিজার্ভের অর্থ পেতে আগ্রহ দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তবে সরকারি খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে ইতিবাচক থাকলেও এখনই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে কোনো আগ্রহী নয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিষয়টি এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখা একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে দেশের আমদানি দায় পরিশোধ প্রায় বন্ধ। একই সঙ্গে আমদানির নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলাও প্রায় স্থবির। দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে ৬৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ আছে। অবস্থায় রিজার্ভের অর্থ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।

রিজার্ভ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়া হলে সেটি আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও। তিনি বলেন, আমাদের দেশের বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না। ঋণ পরিশোধে অকৃতকার্য হলেও বারবার তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। যদিও পৃথিবীর কোনো দেশই অকৃতকার্যদের পুরস্কৃত করে না। বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রফতানির আড়ালেই বছরে - বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাই অর্থের বেশির ভাগ পাচার করেন। পাচারকৃত অর্থ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা বিনিয়োগ করছেন।

. ফরাসউদ্দিন বলেন, এর আগে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশী মুদ্রায় ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও সুযোগের অপব্যবহার আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এখন রিজার্ভ থেকে চিহ্নিত বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ গ্রহণের সুযোগ দিলে তার পরিণতিও ভালো হবে না। উল্টো রির্জাভ থেকে নেয়া ঋণের অর্থও বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। বেসরকারি খাতে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি, ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের নীতিনির্ধারকরা আরো ভাববেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে খুবই অল্প অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের যাত্রা হয়েছিল। অর্থনীতির নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অক্টোবর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার। সাধারণত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখা হয় আপত্কালীন সময়ে খাদ্য আমদানি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য। খাদ্যোৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো আমদানিনির্ভর। বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা থাকলেই চলে। সেপ্টেম্বরে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৪৩০ কোটি ডলার। সে হিসেবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

দেশের রিজার্ভ থেকে সরকারি খাতে বিনিয়োগের বিষয়টি আলোচনা শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। তত্কালীন গভর্নর . আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের কথা তোলেন। ওই বছরই বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্কালীন ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরীকে প্রধান করে সরকার ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিকে তহবিলের কার্যপ্রণালি নির্ধারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী উত্তম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আইন, নীতি কারিগরি দিকগুলো পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে কমিটি তত্কালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর সরকারি প্রকল্পে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও কার্যক্রম এগোয়নি। সম্প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নতুন করে রিজার্ভ থেকে সরকারি বিভিন্ন বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের কথা উঠেছে। সরকারি প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগের সংবাদে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও নড়েচড়ে বসেছেন। একাধিক বড় শিল্প গ্রুপ রিজার্ভ থেকে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচনা করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনালসহ অগ্রাধিকারমূলক কিছু খাতে রিজার্ভ থেকে অর্থ চাইলে তা বিবেচনা করা হবে। কিন্তু বেসরকারি খাতে কোনোভাবেই রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হবে না।

বিশ্বের শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো তাদের রিজার্ভের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করে। প্রকল্পে বিনিয়োগের উদাহরণ আছে এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশগুলোরও। তবে বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর রিজার্ভের অর্থ থেকে বিনিয়োগের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে চীনের। দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ হাজার ১৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হাজার ৩৮৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে জাপানের। ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ৫৬০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ডের রিজার্ভ ২৫১ বিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়ার ১৩৫ বিলিয়ন, মালয়েশিয়ার ১০৭ বিলিয়ন, ফিলিপাইনের ১০০ বিলিয়ন ভিয়েতনামের ৮৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বাংলাদেশের। পাকিস্তানের বর্তমান রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন শ্রীলংকার বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের ৪১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকলেও বর্তমানে সরকারি বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ৬৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ দশমিক বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল শেষে পরিমাণ ৫৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ঋণের মধ্যে ৪১ বিলিয়ন ডলার সরকারি খাতের। বাকি অর্থ এসেছে বেসরকারি উদ্যোক্তা পর্যায়ে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৪৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। সরকারি-বেসরকারি খাতের এসব ঋণ পরিশোধের চাপও থাকবে রিজার্ভের ওপর।

মহামারীর কারণে বাংলাদেশীদের বিদেশযাত্রা প্রায় বন্ধ। একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আমদানি ব্যয় কমেছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অবস্থায় রেমিট্যান্সে বড় উল্লম্ফন রফাতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়িয়েছে। এজন্য বাজার থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে অক্টোবর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৩৬০ কোটি ডলারেরও বেশি কিনে নিয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাজার থেকে ডলার না কিনে উল্টো বিক্রি করতে হবে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা।

বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেবল সরকারি প্রকল্পে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত রয়েছে। রিজার্ভ হলো আমাদের দেশের ভাবমূর্তির বিষয়। এটিকে বিতর্কিত করা ঠিক হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন