শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনতে চাই

অধ্যাপক . এএসএম মাকসুদ কামাল দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে। এর আগে অনুষদের ডিন, হল প্রভোস্ট বিভাগীয় প্রধানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষক সংগঠনের। কভিডকালীন কভিড-পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ গবেষণাসহ উচ্চশিক্ষার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ সুজন

কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পেয়েছেন। শুরুতেই অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো সংকট, সেশনজটের আশঙ্কাসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। বিষয়গুলো নিয়ে কী ভাবছেন কী করছেন?

গোটা বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থায়ই কভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছে ঠিক; তবে সব দেশে এর প্রভাব বা ক্ষতির ধরন এক নয়। যেমন, উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে থাকেই -লার্নিং পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিল। যদিও আমাদের সেই ধরনের পরিচিতি অতীতে ছিল না। অনলাইন এডুকেশনের জন্য যে অবকাঠামো দরকার সেটিও আমাদের ছিল না। তবে আমরা থেমে নেই। আমরা কভিডকালীন কভিড-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছি। আমরা আমাদের উইকনেস স্ট্রেন্থ এরই মধ্যে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এখন আমরা অনলাইন এডুকেশনকে সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করছি। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের যে কমিটি হয়েছে, সেখান থেকে ডিনদের মাধ্যমে বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভাগগুলোকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে পাঠদান চালু রাখতে বলা হয়েছে। কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থী অনলাইন এডুকেশনের আওতায় আসতে পারছে না। এটা সত্য, ইকুইটি (সমতা) ইনক্লুসিভনেস (অন্তর্ভুক্তিমূলক) এখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। তবে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও (ইউজিসি) পদক্ষেপ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের যাতে শিক্ষাজীবনের কোনো অপচয় না ঘটে, পাশাপাশি তারা যেন মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেশিক্ষক হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে এটি মূল লক্ষ্য।

শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে অসমতা বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কীভাবে কাটিয়ে তুলবেন?

কভিডের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে সব শিক্ষার্থীকে অনলাইন কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসা হবে। অনলাইন ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কভিড-উত্তর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে অনলাইনে পড়ানো কোর্সগুলো রিভিউ করার চেষ্টা করব। আর এখনো অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে কভিড পরিস্থিতির কারণে যদি অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হয়, সেই ধরনের প্রস্তুতিও আমরা নিতে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের সেশনজটে যেন পড়তে না হয়, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি কমিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। পাশাপাশি আমরা অধিকতর ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি সমাধানের চেষ্টা করব। আমরা দেখেছি, শিক্ষকরা যখন ক্লাস নেন অনেক সময় ইন্টারনেটের গতির দুর্বলতা থাকে। লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ককে আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্য দিয়ে লোকাল নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হবে। আর শিক্ষার্থীদের ডাটা প্যাকেজ কেনার জন্য বিভাগগুলো থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সুপারিশটা প্রণয়ন করেছি সেখানেও বিষয়টা রয়েছে। অনলাইন এডুকেশন যদি দীর্ঘায়িত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে ডাটা প্যাকেজ পেয়ে শিক্ষার্থীরা অনলাইন এডুকেশনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য আমরা সচেষ্ট আছি।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে আপনারা কী ভাবছেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে তো হলগুলোও খুলে দিতে হবে। আবাসিক হলগুলোতে গণরুমসহ অন্যান্য কক্ষেও শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকার সংস্কৃতি ছিল। এখন কভিড-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা কেমন হবে?

কভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে যতদিন পর্যন্ত আমরা ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ মনে না করি, ততদিন পর্যন্ত ক্যাম্পাস খোলাটা সমুচিত হবে না। ক্যাম্পাস তখনই খোলা হবে, যখন আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারব। পাশাপাশি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করে, সেজন্য একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে প্রসিডিউর তৈরি করছি। বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রভোস্টদের নিয়ে সভা করেছে। সে সভায় ছাত্রত্ব শেষ হওয়া অবৈধ অবস্থানকারীরা যেন হলে থাকতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা কার্যকর হলে আমার ধারণা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের হলে থাকার সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। বহু শিক্ষার্থী হলে থাকে বিশেষ করে প্রথম বর্ষ এবং দ্বিতীয় বর্ষের অনেক শিক্ষার্থী, যাদের নামে হলে আসন বরাদ্দ থাকে না। এজন্য গ্রামগঞ্জ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার জন্য ঢাকায় অবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঢাকায় অনেক শিক্ষার্থীর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই, অনেকের আর্থিক সামর্থ্য নেই শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও ভাবা উচিত।

আসলে কভিড-১৯-এর আগের পৃথিবী এবং আজকের পৃথিবী সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের জীবনচরিত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা আনার জন্য যে কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করার দরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই পথেই অগ্রসর হবে। সেজন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থের বিষয়টা ভাবতে হবে। আমরা তাদের পরামর্শ দেব। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টা অনুসরণ করে তারা যেন শ্রেণীকক্ষে আসে, হলে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। যখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে, শিক্ষার্থীরা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই ক্যাম্পাসে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। ল্যাবগুলোও দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ব্যবহার হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ল্যাবের যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট কিংবা অকেজো হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কী...

ল্যাবগুলোর কথা বিবেচনা করেই বর্তমানে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডিন মহোদয়দের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যেন ডিপার্টমেন্টগুলো খোলা রাখা হয়। চেয়ারম্যানরা যেন বিভাগে আসেন এবং ল্যাবগুলো দেখাশোনা করেন। সেখানে যেন ল্যাবগুলো চালু রাখা হয়, যাতে যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে না যায়। এটা সঠিক একটা ল্যাব যদি দীর্ঘদিন ব্যবহূত না হয়, সেখানে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। এটি হলো কভিড-১৯-এর বাস্তবতা। বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। খোলার পর ল্যাবগুলোর সঠিকভাবে কার্যক্রম যাতে চালু করা যায়, সেজন্য আমাদের আর্থিক বরাদ্দেরও প্রয়োজন হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিষয়গুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করে সরকারের কাছ থেকে সে ধরনের সহযোগিতা হয়তো আমরা চাইব, যাতে আমাদের ল্যাবগুলোকে আধুনিক করা যায়। আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আমরা সে ধরনের সহযোগিতা পাব।

উপ উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমের বড় একটি অংশই আপনার দপ্তরের অধীন। গত কয়েক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি বিভিন্ন সময় সামনে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার দর্শন কী হবে?

বৈশ্বিকভাবেই মানসম্মত শিক্ষকের একটি অভাব অনুভূত হচ্ছে। আমরা প্রায় সময় শুনি বিভিন্ন মহল থেকে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর কথা বলা হয়। শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের সাধ সাধ্যের মধ্যে পরিকল্পনা করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, আমাদের অনেক ডিপার্টমেন্টে ধারণক্ষমতার অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এখন একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে যান, ক্লাস সাইজ যদি বেশি বড় হয় তাহলে সব শিক্ষার্থীর কাছে পাঠদান সমানভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, শিক্ষকদের মনোযোগ দুটোই ব্যাহত হয়। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের তথ্য-উপাত্তগুলো পায় না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বস্তুত কয়েক বছর ধরে নয়, অনেকদিন পর্যন্ত, আমি বলব কয়েক দশক পর্যন্ত ধরনের বিতর্ক অব্যাহত আছে। এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি সেটার একটা সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন আনা যায় কিনা সে চিন্তাভাবনা করছি। আশা করি পরিবর্তনটা যদি সবাই আলাপ-আলোচনা করে করতে পারি, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর একাডেমিক হিসেবে পরিকল্পনাটি আমার আছে। আমরা পরিকল্পনাটিকে আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য কাজ শুরু করেছি। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা বর্তমানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করি পদ্ধতির সংস্কার নীতিমালার উন্নয়ন করে আমরা যদি শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে পারি, তাহলে বিতর্ক বহুলাংশে কমে আসবে। নীতিমালার উন্নয়ন সংস্করণ নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি। নিকট ভবিষ্যতে কাজটি আমরা করব। আশা করি আমরা সফল হব।

সান্ধ্য কোর্সগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। বিষয়ে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সান্ধ্য কোর্স থাকবে কি থাকবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এরই মধ্যে একটি কমিটি হয়েছে। যদি থাকে, তাহলে কীভাবে থাকবে সে-সংক্রান্ত একটি কমিটি হয়েছে। এটি অনেক বড় কমিটি। কভিডের কারণে আমরা এখনো বসতে পারিনি। আশা করি কভিড-উত্তর সময়ে সবাই বসে বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেটি মাথায় রেখে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে যে নিয়ম-বিধি আছে, সেগুলোকে অনুসরণ করে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন