লকডাউন শেষে কমে এসেছে পারিবারিক সহিংসতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা সংক্রমণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে লকডাউন বা ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল সরকার। এতে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। এর প্রভাবে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাও বেড়ে যায়। ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের এক গবেষণাতে বিষয়টি উঠে আসে। তবে লকডাউন-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করলে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

লকডাউন-পরবর্তী সময়ে পারিবারিক সহিংসতা কমে আসার বিষয়টি জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। তাদের তথ্যমতে, সাধারণ সময়ের তুলনায় লকডাউনের মধ্যে গৃহকেন্দ্রিক নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ বেশি পেয়েছে। তবে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বরাবরই পুলিশ সচেষ্ট থেকেছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর লকডাউন-পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।

ইন্টার্যাপটেড টাইম সিরিজ পদ্ধতি ব্যবহার করে রূপগঞ্জ উপজেলার গ্রামাঞ্চলের কিছু পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করেছে দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ। যাদের দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নেয়া হয়েছে তারা এর আগে এক দৈবচয়ন নিয়ন্ত্রিত গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। গ্রামবাংলার মহিলা এবং তাদের পরিবারের ওপর কভিড-১৯ জনিত লকডাউনের তাত্ক্ষণিক প্রভাব জানাই এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেছে দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ। 

গত ১৯ মে থেকে ১৮ জুনের মধ্যবর্তী সময়ে জরিপে অংশ নেয়ার জন্য ৩ হাজার ১৬ জন শিশুর মাকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে আমন্ত্রণ জানায় দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ। এর মধ্যে ২ হাজার ৪২৪ জন এ জরিপ কার্যক্রমে অংশ নেন। এর মধ্যে বাড়িতে থাকা পরামর্শ সম্পর্কে জানতেন এবং তা মেনে চলেছেন ২ হাজার ৪১৪ জন, যা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ। লকডাউনের মধ্যে সংসারের রোজগার কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন ২ হাজার ৩২১ জন, যা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ। 

লকডাউনের সময় গৃহকেন্দ্রিক অপরাধ ও নির্যাতনের ঘটনাও সাধারণ সময়ের তুলনায় বেড়ে গিয়েছিল। দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মায়েদের হতাশা এবং দুশ্চিন্তাজনিত লক্ষণগুলো লকডাউনের সময় বেড়ে গিয়েছিল। মহিলাদের মাঝে যারা আবেগীয় সমস্যায় ভুগছিলেন এবং মাঝারি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদের অর্ধেকের বেশি বলছেন যে এটা লকডাউনের সময় বেড়ে গিয়েছে। 

দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের গবেষণায় অংশ নেয়া নারীদের মধ্যে ২ হাজার ১৭৪ জন তাদের স্বামীদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এসব নির্যাতনের মধ্যে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত ছিল। মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ছিল অপমান করা, অবনমিত করা, ভয় দেখানো ও ধমক দেয়া। এ সময় নারীরা সহনীয় ও অতিমাত্রার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সহনীয় মাত্রার নির্যাতনের মধ্যে ছিল থাপ্পড় দেয়া কিংবা কোনো কিছু ছুড়ে মারা এবং ধাক্কা দেয়া কিংবা চুল ধরে টানা। আর অতিমাত্রায় শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে কিল-ঘুষি দেয়া, লাথি, টেনে নিয়ে যাওয়া, প্রহার, গলা চেপে ধরা, ছ্যাঁকা দেয়া এবং অস্ত্র দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো। এর বাইরে যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে রয়েছে জোরপূর্বক যৌনমিলনে বাধ্য করার মতো ঘটনা। গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়, লকডাউন সময়কালীন মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা আগের তুলনায় বেড়েছে।  

গ্রামের পরিবারগুলোর আয় কমে এসেছিল লকডাউনের সময়। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষণার তথ্যমতে লকডাউনের আগে পরিবারগুলোর মাসিক গড় আয় ছিল ২১২ ইউএস ডলার, যা পরবর্তী সময়ে কমে ৫৯ ইউএস ডলার হয়েছে। অধিকন্তু প্রতিদিন ১ দশমিক ৯০ ডলারের নিচে আয় করা পরিবারের সংখ্যা আগের তুলনায় শূন্য দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে লকডাউনের সময় ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।

লকডাউনের সময় খাদ্য সংকটের বিষয়টিও প্রবল হয়ে উঠেছিল। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, মহামারীর আগে যেখানে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের যথাক্রমে মাঝারি ও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ছিল। পরবর্তী সময়ে লকডাউনের সময় তা বেড়ে যথাক্রমে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিষয়টি, যা পরিবারগুলোর অনুভব করেছে তা ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।

লকডাউন নিয়ে রয়েছে মায়েদের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। জরিপে অংশগ্রহণকারী মায়েদের মধ্যে অধিকাংশই বা ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ লকডাউন নিয়ে খুবই হতাশ ছিলেন। মহামারী বিবেচনায় লকডাউন পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছিলেন ১৯ শতাংশ। আর জরিপে অংশ নেয়া মায়েদের মধ্যে লকডাউনকে উপভোগ করেছেন মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ নিরন্তর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। চলমান করোনাকালে জনগণকে মানবিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ অপরাধসহ লকডাউনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা গৃহকেন্দ্রিক অপরাধ দমনেও বিশেষভাবে কাজ করছে পুলিশ। নেয়া হয়েছিল নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও। লকডাউনের পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এ ধরনের অপরাধ বা পারিবারিক সংকট কমে এসেছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন অধিকাংশ পরিবারের জন্যই সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এর অন্যতম কারণ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ও তাদের মাঝে বিবাহবহির্ভূত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সংকট। এ ধরনের সংকট থেকে গৃহনির্যাতনের মতো অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল লকডাউনে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে এ সংকট ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, লকডাউনে দুই ধরনের প্রভাব আমরা পরিবারগুলোতে লক্ষ্য করেছি। অনেক পরিবারের মাঝে লকডাউনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সাধারণ সময়ে হয়তো একজন স্বামী তার স্ত্রীকে প্রত্যাশিত সময় দিতে পারেননি। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে দুজনই দুজনকে প্রত্যাশা অনুযায়ী সময় দিয়েছেন, যার ফলে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বেড়েছে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ পরিবারে লকডাউনের মধ্যে দাম্পত্য কলহ তৈরি হতে দেখা গেছে। কারণ এ সময়ে স্বামী ও স্ত্রী খুব কাছাকাছি থাকায় তারা দুজনই দুজনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন। এতে একে অপরের ছোট ভুলগুলো খুব সহজেই শনাক্ত করতে পেরেছে। পরবর্তী সময়ে সেই ভুলগুলো নিয়ে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা এমনকি গায়ে হাত দেয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে, যার ভিত্তিতে লকডাউনের সময় পারিবারিক সংকট বেড়ে গিয়েছিল। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন