সাশ্রয়ী ও শক্তিশালী অ্যান্টিবডি থেরাপির সন্ধানে

বণিক বার্তা ডেস্ক

যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কভিড-১৯- আক্রান্ত হলেন, তার ডাক্তাররা বেশকিছু ওষুধ নিয়ে হাজির হলেন, যার কোনোটা প্রমাণিত এবং কোনোটা পরীক্ষামূলক। তবে সেরে ওঠার জন্য একটি ওষুধের খুব প্রশংসা করেছেন প্রেসিডেন্ট: করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডির একটি ককটেইল, যা তৈরি করেছে নিউইয়র্কের রেগেনেরন ফার্মাসিউটিকালস।

অ্যান্টিবডি চিকিৎসার সারিয়ে তোলার শক্তি এখনো প্রমাণিত হওয়া বাকি আছে। যদিও কভিড-১৯-এর মৃদু উপসর্গের ক্ষেত্রে এটি স্বল্প পরিসরে প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে, কিন্তু এখনো বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়নি। এর মাঝে গবেষকরা আরো অগ্রসরমান অ্যান্টিবডি চিকিৎসা ডিজাইন করেছেন, যা কিনা সাশ্রয়ী, সহজেই উৎপাদনযোগ্য অধিক শক্তিশালী।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়োকেমিস্ট পামেলা বিজোরকমান বলেন, সবাই সত্যিকার অর্থে এমন কিছু চান যা এত দারুণভাবে শক্তিশালী যে খুব অল্পই প্রয়োজন হবে। আপনি চাইবেন বাসায় কিংবা হাসপাতালে অথবা স্কুলে বা মাংস প্যাকেটজাত করা কারখানায় যারা কাজ করে সবাইকে এটি দিতে।

অ্যান্টিবডি হচ্ছে সার্স-কোভ--এর বিরুদ্ধে শরীরের স্বাভাবিক ইমিউন প্রতিক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গবেষকরা এখন প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করার জন্য, যা কিনা ভাইরাল প্রোটিনের সঙ্গে সরাসরি আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতাকে কাজে লাগায় এবং ভাইরাসকে প্রতিলিপি তৈরি করা থেকে প্রতিহত করে।

এটা করার একটা উপায় হচ্ছে, সেরে ওঠাদের রক্তের প্লাজমাকে ব্যবহার করে উৎপাদিত অ্যান্টিবডি অন্যদের কাছে স্থানান্তর করা। আরেকটি হচ্ছে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি এবং ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা, যা কিনা শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়ার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

রোগের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়ার সফলতা প্রমাণিত। ১৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) তিনটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির একটি ককটেইল অনুমোদন করেছে। যা উৎপাদিত হয়েছে রেগেনেরনের দ্বারা, যা ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। এটি দ্বারা কঙ্গোয় ভাইরাসে মৃত্যুহার হ্রাস পেতে দেখা গেছে।

প্রাথমিক ট্রায়ালের সফলতা

কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি চিকিৎসা বিকাশের প্রতিযোগিতায় মুহূর্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে রেগেনেরন ইলি লিলি। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব কোম্পানির তৈরি অ্যান্টিবডিগুলো পরীক্ষা করে দেখছে এবং প্রাথমিক পরীক্ষার দ্বারা সমর্থিত হয়ে এখন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। ইলি লিলির প্রথম অ্যান্টিবডি থেরাপি রোগীদের হাসপাতালে যাওয়ার হার হ্রাস করেছে। রেগেনেরনের দুটি অ্যান্টিবডির মিশ্রণ উপসর্গ ভাইরাল লোড হ্রাস করেছে।

এখানে মূল আশার জায়গাটি হচ্ছে অ্যান্টিবডি থেরাপি কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গকে মারাত্মক রূপ ধারণ করা থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে কভিড-১৯-এর মারাত্মক অবস্থার ক্ষেত্রে ধরনের চিকিৎসা থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা পাওয়ার আশা সামান্য। কারণ তখন ক্ষতির কারণ কেবল ভাইরাসে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেখানে শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়ারও দায় থাকে। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার সংক্রামক রোগের ডাক্তার মাইরন কোহেন অবশ্য উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, আমি ভাবতেই পারছি না, ওষুধগুলো যদি উপলব্ধ হয় এবং নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হয় তখন আমি কতটা রোমাঞ্চিত বোধ করব।

কভিড-১৯-এর অন্তত দশটি অ্যান্টিবডি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার অনেকগুলোই বিকাশমান অবস্থায় আছে। সার্স-কোভ--এর সঙ্গে কতটা ভালোভাবে আবদ্ধ হতে পারে, সে বিবেচনায় প্রার্থীরা কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা প্রস্তাব করে, বলছিলেন কেমিস্ট ঝিকিয়াং আন। তার মতে, মাত্রাগতভাবে এখানে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এখানকার বেশির ভাগ অ্যান্টিবডির কিছু না কিছু কার্যকারিতা থাকে।

পাশাপাশি গবেষকরা উপায় খুঁজছেন এসব চিকিৎসার বিরুদ্ধে ভাইরাসের প্রতিরোধী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে হ্রাস করতে। যখন একটি অ্যান্টিবডি ব্যবহূত হয়, তখন ভাইরাসের পক্ষে মিউটেশনগুলোর বিকাশ ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে। যা কিনা অ্যান্টিবডিকে এড়ানোর সুযোগও প্রদান করে। সেই সব চিকিৎসা যেখানে একাধিক অ্যান্টিবডি যুক্ত থাকে, যেমন রেগেনেরনের থেরাপি, যেটি ট্রাম্প গ্রহণ করেছেন সেটি ভাইরাসের কাজটি করার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। যেখানে একাধিক অ্যান্টিবডি বিভিন্ন সাইটের সঙ্গে আবদ্ধ হয়।

তার পরও এখানে ত্রুটি আছে। অ্যান্টিবডি বেশ দামি এবং এটি বানানোও কঠিন। পাশাপাশি এগুলো দেয়া হয় উচ্চ ডোজে। অনেক গবেষক বলেছেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সর্বোচ্চ গ্রাম অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়, যা ট্রাম্প গ্রহণ করেছেন। ভাইরোলজিস্ট জেরাল্ড ম্যাকলারনে বলেন, এটা অনেক বেশি ডোজ। এমনকি এটি যদি কাজ করেও, তবে তা অবিশ্বাস্য রকমের দামি। অবশ্য নিম্ন ডোজও পরীক্ষা করা হয়েছেরেগেনেরনের নিম্ন ডোজটি ছিল . গ্রামের। যা কিনা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা হিসেবে বিস্তৃত ব্যবহারের দিক থেকে অনেক বেশি।

আলপাকা থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডি

ম্যাকলানে অন্যরা ন্যানোবডি নামক অ্যান্টিবডি জাতীয় ছোট অণুর বিকাশে কাজ করছে, যা হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে ক্যামেলিডস (উটজাতীয় প্রাণী) দ্বারা এক ধরনের অ্যান্টিবডিভিত্তিক। যেখানে আলপাকা লামাসও অন্তর্ভুক্ত। ন্যানোবডি বানানো সহজ এবং প্রায়ই ব্যাকটেরিয়াল কোষে উৎপাদন করা যায়, এটি সাশ্রয়ী। গত বছর এফডিএ ন্যানোবডির প্রথম থেরাপির অনুমোদন দিয়েছে, যাকে বলা হয় কাপলাসিযুমাব। এটি দুর্লভ রক্ত জমাট বাঁধার একটি চিকিৎসা।

কিন্তু প্রযুক্তিটি এখনো তুলনামূলকভাবে নতুন এবং কভিড-১৯ ন্যানোবডি চিকিৎসা ক্লিনিকের প্রচলিত অ্যান্টিবডিগুলোকে অনুসরণ করে। ম্যাকলানের দল গুরুতর সার্স-কোভ- প্রোটিন যাকে স্পাইক প্রোটিন বলা হয়। তার বিরুদ্ধে একটি ন্যানোবডিকে বিচ্ছিন্ন করেছে টাইসন নামে আলপাকা থেকে। তারা অ্যান্টিবডিগুলোকে ল্যাবে আরো সক্রিয়, স্থির এবং মানুষের মধ্যে কাজ করার উপযোগী করে তুলেছে। যদিও সেগুলো এখনো প্রাণীদেহে পরীক্ষা করা হয়নি।

কোনো কোনো গবেষক আশা করছেন এমন ন্যানোবডি বিকশিত করার, যা কিনা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা যাবে। এর ফলে সরাসরি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সাইটকে সুরক্ষা দেয় যাবে, যা মূলত নাক ফুসফুস। চীনের সাংহাইয়ে নোভামাব বায়োফার্মাসিউটিক্যাল মূলত হাঁপানির চিকিৎসার জন্য নিঃশ্বাসে গ্রহণ করা যায় এমন ন্যানোবডি তৈরি করত, যা এখন কভিড-১৯-এর ন্যানোবডির বিকাশের কাজ করছে। কোম্পানিটি এখন আন্তর্জাতিক পার্টনারের সন্ধানে রয়েছে। বিশেষ করে সেসব অঞ্চলে যেখানে কভিড-১৯ বিস্তৃত হচ্ছে।

বায়োকেমিস্ট পিটার ওয়াল্টার আশা করেন যে নিঃশ্বাসে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া ধরনের অ্যান্টিবডি স্বল্প ডোজেও অধিক কার্যকারিতা দেখাতে পারে। তার মতে, আমরা ধারণা করি এটা প্রতিষেধক স্প্রে হিসেবে ব্যবহূত হবে। যেখানে বিমানে চড়ার আগে কিংবা পার্টিতে যাওয়ার আগে আপনি হয়তো এটি স্প্রে করে নিলেন।

নেচার জার্নাল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন